Ticker

6/recent/ticker-posts

আপনি ব্রাজিল না’কি আর্জেন্টিনা ?

আপনি ব্রাজিল না’কি আর্জেন্টিনা ?  

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

ভাইরাস এবং ভাইরাল দুইটিই রোগ ছড়ায়। একটি বাস করে মানুষের শরীরে, আরেকটি বাস করে মানুষের মনে। শরীরকে ভাইরাস আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নানান চেষ্টা থাকলেও, ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আমরা সাধারণত বাঁচার চেষ্টা করিনা বরং স্বেচ্ছায় এ রোগে নিজেকে সমর্পণ করি এবং অন্যদেরকেও ভাইরাল রোগে আকৃষ্ট করে থাকি। এই জন্যই বুজে না বুজে ভাইরাল বিষয়ে কথা বলতে আমরা পছন্দ করি। কোন বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞর মত মতামত জানাতে সারা বিশ্বে আমাদের জুড়ি নেই।

সারা বছর যারা খেলা দেখে না, এমন কী খেলা বুজেও না তারাও এখন জিজ্ঞেস করে ভাই আপনি আর্জেন্টিনা নাকি ব্রাজিল। আর তাই সাম্প্রতিক সময়ে কোপা আমেরিকা ফুটবল ভাইরাল রোগ থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলাম না। অবশ্য এই রোগটি করোনা ভাইরাসের মত নতুন কোন রোগ নয়। কয়েক বছর পরপরই সারা বিশ্বে এই রোগটি ছড়িয়ে থাকে।


এইরকম একটি রোগ আক্রান্ত জৈনক ব্যক্তির সাথে আমার কথোপকথন এইপর্যায়ে তুলে ধরলাম। কথোপকথনটি নিম্নরুপ।

জৈনক ব্যক্তি ঃ- ভাই, আর্জেন্টিনা নাকি ব্রাজিল, আপনি কোন দল সাপোর্ট করেন।

আমি ঃ- আরে ভাই আমি তো বাংলাদেশী, বাংলাদেশ দলকে সাপোর্ট করি।

জৈনক ব্যক্তি ঃ- কি কন ভাই, আপনি বোকা নাকি, বাংলাদেশতো ফুটবলে বিশ্বকাপ খেলে না। কোপার ক্যাটাগরীতেও পড়ে না। ফুটবল বিশ্বকাপে বা কোপা আমেরিকায় টুর্নামেন্টে আপনি কোন দল সাপোর্ট করেন, সেইডা জানতে চাচ্ছি।

আমি ঃ- কি কইলেন ভাই, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলে না। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে না খেললে, যারা খেলে তাদের যে কোন একটা দেশের দলকে সাপোর্ট করলেই কি; আর না করলেই কি। ধরেন আমি আর্জেন্টিনারে সাপোর্ট করলাম, এখন আর্জেন্টিনা যদি খেলায় হেরে যায় তাইলে আমার কি কোন বদনাম হইবো। আমার কোন ভুলের কারণে তো তারা হারে নাই। আবার ব্রাজিল যদি জিততা যায়, এই ব্রাজিল জিতার পিছনে তো আমার কোন হাত নাই। তাইলে যেই দলের হার-জিতের পেছনে আমার কোন ক্রেডিট নাই, সেই দল সাপোর্ট করে আমার কি লাভ। সেই দলের আনন্দে আমার কিসের আনন্দ, সেই দলের পরাজয় আমার কিসের লজ্জা !

জৈনক ব্যক্তি ঃ- আরে মিয়া আপনার এই কথা মত বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়ের পিছনেও তো আপনার কোন ক্রেডিট নাই। বাংলাদেশ যে সমস্ত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলে সেখানে বাংলাদেশ হারলে মন খারাপ করেন ক্যান বা জিতলে আপনি খুশি হন ক্যান ?


আমিঃ- কি কন ভাই আপনে, বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, মাতৃভূমি। আমার দেশের সব কিছুর সঙ্গেই আমার জন্মগত সম্পর্ক। এর ভালো-মন্দের প্রত্যেকটা জিনিস আমাকে নাড়া দিবো। বাংলাদেশের সফলতা আমার সফলতা। এর ব্যর্থতা আমার ব্যর্থতা। আর তাছাড়াও বাংলাদেশ টিমের সকল খরচ তো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত হয়। সেখানেতো আমার বা জনগণের অংশগ্রহণ থাকে। কাজেই যেমুনিই খেলুক নিজ দেশের সাথে অন্যদেশের কোন তুলনা নাই।

জৈনক ব্যক্তি ঃ- ঠিক আছে আপনার যুক্তি মাইনা নিলাম। যেহেতু নিজের দেশ খেলা না সেহেতু নানান দিক চিন্তা কইরা আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সাপোর্ট করতেই পারি। অনেক দেশের সঙ্গে আমরা নানান ভাবে যুক্ত। কোন কোন দেশের সাথে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যর সম্পর্ক আছে। কোন দেশ আবার প্রতিবেশী। কোন দেশে আমাদের আত্মীয়-স্বজন থাকে। কোন দেশে আমরা লেখাপড়া করেছি।  সেই হিসাবে তো কোন একটি দেশকে সাপোর্ট করতেই পারি। তাছাড়া কোন দেশের খেলা বা কোন বিশেষ প্লেয়ারের খেলা আমার ভালো লাগতে পারে। তাহলে সেই দেশকে সাপোর্ট কি আমি করতে পারি না ?

আমিঃ- হ্যাঁ তা করতে পারেন। নিজ দেশের দল না খেললে অন্য কোন দেশের প্রতি  আপনার সাপোর্ট থাকতে পারে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত ভালোবাসা দেখাতে পারেন। তবে সেই সাপোর্ট বা ভালোবাসা যেন অতি উৎসাহী, অতি আবেগী পর্যন্ত না যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত আবেগ দেখাতে হবে। আপনার সার্পোট করা দলের জার্সি গায়ে দেয়া বা পতাকা উড়ানোর যেতেই পারে। তবে তারও একটা লিমিট থাকা দরকার। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না।


জৈনক ব্যক্তি ঃ-  হ্যাঁ ভাই তা ঠিক কইছেন। আর আমরাও এগুলি মজার জন্যই করি। কিন্তু কিছু মানুষ এগুলোকে সিরিয়াসলি নেয়। তারাই সমস্যা তৈরী করে।

আমিঃ- আর একটা কথা মনে রাখবেন ভাই। খেলাধুলা হচ্ছে শরীরচর্চা ও বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। বর্তমানে খেলধুলা বিশ্বভাতৃত্ব তৈরি, কর্মসংস্থান ও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টির উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। তাছাড়াও প্রতিটি দেশের যুবসমাজকে মাদকাসক্ত থেকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম উপায় বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা। খেলাধুলাকে এই পর্যায়েই রাখা উচিত। আজকাল খেলাধুলা নিয়ে অতি আবেগ দেখাইতে যেয়ে  প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যে নানা রকম কুৎসা রটনা করা হয়, হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। কিছু কিছু জায়গায় মারামারি কাটাকাটি হয়ে যায়,  এসব যেন না হয় সে বিষয়ে সবার খেয়াল রাখতে হবে।

জৈনক ব্যক্তি ঃ-  হ্যাঁ ভাই তা ঠিক কইছেন। যে দেশে খেলা হয় সেই দেশে কোন সংঘাত নাই কিন্তু আমাদের দেশে নানা জেলায় খেলা নিয়ে অপ্রীতিকর সংবাদ পাওয়া যায়। এসব মোটেও ঠিক নয়।


আমিঃ- সবকিছুরই একটি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব থাকে। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেক জিনিসের ইতিবাচক ব্যবহারটাই করতে হবে। নেতিবাচক বিষয়গুলো পরিহার করতে হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি যখন একটি দলের সাপোর্ট করছেন এর মানে এই যে, সেই দলটি খুব ভালো খেলে। তেমনি ভাবে অন্যজন আরেকটি দল সাপোর্ট করছে, তার মানে এই যে, সেই দলও ভালো খেলে। ভালো না খেললে তারা ফাইনাল খেলবে কেন।

যেহেতু দুই দলই ভালো খেলে, সেহেতু অন্য দলকে বা অন্য দলের সাপোর্টার কে আপনার মন্দ বলার সুযোগ কই। একটি দল সব সময় ভালো খেলে না। সবসময় ভালো খেলবে বিষয়টা এমনও না। একটি দলই সবসময় যদি জিতে যায় তাহলেতো আর খেলা হলো না। খেলা মানেই হার-জিত। খেলা মানেই তো একদল একসময় ভালো খেলবে, আরেকদল আরেক সময় ভালো খেলবে। এই প্রতিযোগিতা থাকে বলেই তো বছর বছর খেলা হয়। প্রতিযোগিতা না থাকলে খেলা হারিয়ে যাবে। খেলার গুরুত্বও হারিয়ে যাবে। আপনার খেলা দেখার সাধ মিটে যাবে। সাপোর্ট করার তো প্রশ্নই থাকবে না।

জৈনক ব্যক্তি ঃ-  সবই বুঝলাম, এবার বলেন এবছর যারা কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে খেলছে তাদের মধ্যে থেকে আপনি এখন কোন দল সাপোর্ট করবেন। মানে আর্জেন্টিনা নাকি ব্রাজিল। বেশির ভাগ মানুষতো এই দুই দলকেই সাপোর্ট করে।


আমিঃ- দেখেন ভাই ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের রাজা পেলের নাম শুনেছি। আমাদের পাঠ্য বইয়ে তাঁকে নিয়ে একটি গল্পও ছিলো। সেই সময় থেকে পেলের ভক্ত এবং তাঁর দল ব্রাজিলের সাপোর্টার আমি। ব্রাজিলিয়ানরা জাত খেলোয়ার। সেলেসাওদের হলুদ পতাকা দেখলেই কেমন একটা ঐতিহ্য ঐতিহ্য ভাব আসে। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা আর্ন্তজাতিক ম্যাচ খেলে।  ৫ বার বিশ্বকাপ জয়ী তারা আর ৯ বার কোপার শিরোপা জিতেছে । পেলে, গরিঞ্চা, সক্রেটিস, রোমারিও, জিকো, রোনালদো, রোনাল দিনেহো, কাকা ও বর্তমান নেইমারের মত অসংখ্য বিশ্বখ্যাত তারোকা খেলোয়ার আজো ব্রাজিলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

তবে ভাই কোন দল সাপোর্ট করার অর্থ এই নয় যে সেই দল জিতলে তার পক্ষে আর হারলে তারপর বিপক্ষে অতি আবেগ দেখাবো। আমার দল জিতলেও আমি এটা নিয়ে খুব উৎফুল্লতা দেখাই না, হারলেও খুব লজ্জিত হই না। কারণ আগেই বলেছি কারণ তাদের হার-জিতের মধ্যে আমার কোন ক্রেডিট নাই।

তবে হ্যাঁ খেলা দেখতে যেয়ে আমাদের পারস্পারিক একটি বন্ধন, প্রতিযোগিতা বা আড্ডা অথবা হাস্যরস সৃষ্টি হয় তা উপভোগ করা যায়। তবে সংঘাত কখনোই কাম্য নয়। খেলুন, খেলা দেখুন, হারজিত উপভোগ করুন। নেতিবাচক মনোভাব, সংঘাত করা বন্ধ করুন।


জৈনিক ব্যক্তিঃ- ঠিক বলেছেন ভাই। তবে আমি কিন্তু আর্জেন্টিনার সার্পোটার। একটা দেশ সারা বিশ্বে পরিচিত শুধুমাত্র ফুটবল খেলে। তারাও শতবছর ধরে ফুটবল খেলে। দুবার বিশ্বকাপ আর ১৪ বার কোপার শিরোপা জিতেছে। এই দেশে আছে ফুটবলের ঈশ্বর ম্যারাডোনা ও মেসিরমত ফুটবলের মুকুটহীন সম্রাট। জানেত্তি, মাশ্চেরানো, বাতিস্তুতার মত খেলোয়ারগণ সাদা আকাশী পতাকা গায়ে জরিয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন। আর্জেন্টেইনরা ফুটবল খেলে জাদুর মত। ওদেকে সাপোর্ট না করে পারা যায় না ভাই।

আমিঃ- ঠিক বলেছেন ভাই। আসলে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা আছে বলেই বিশ্বব্যাপী ফুটবলের জনপ্রিয়তা আছে। তাদেও ভক্ত আছে সারা পৃথিবীতেই। দেখা যাক এবার ফাইনালে কোন দল জিতে। আপনাদের মেসি নাকি আমাদের নেইমার।

ঠিক আছে ভাই কতা হবে ১১ তারিখ সকালে।

কথাগুলি হচ্ছিলো গত ০৮ জুলাই। ১১ তারিখ সকালে ফাইনাল ম্যাচের পর সেই ব্যক্তি  আমাকে ফোন দিল।


জৈনক ব্যক্তিঃ- কি ভাই আপনার ব্রাজিল তো হাইরা গেছে। 

আমিঃ- হ্যাঁ ভাই দেখলাম তো হাইরা গেছে।

জৈনক ব্যক্তিঃ- তাইলে কি আপনি ব্রাজিলের সাপোর্ট ছাইড়া দিয়া আর্জেন্টিনা করবেন।

আমি ঃ- কি কন ভাই, যখন সাত গোল খাওয়ার পরেও যখন ব্রাজিলের সাপোর্ট ছাড়ি নাই। এক গোল খাইয়া ব্রাজিলের ছাইড়া দেই কেমনে। ব্রাজিল তো ফুটবলের একটা ব্রান্ড। তাছাড়া এবার কাপটা ইচ্ছে করেই আপনাদের দিয়া দিলাম। ২৮ বছর ধইরা কাপ পান নাই আপনারা এই জন্য একটু মায়া হইল আর কি। আপনারা তো বলেন মেসি ফুটবলের সম্রাট। সম্রাটের মাথায় মুকুট না থাকলে কেমন লাগে ! তাই এবার কাপটা দিয়ে দিলাম। 

জৈনিক ব্যক্তি ঃ-  হা হা ভাই মজাতো আপনেও কম করেন না। কিন্তু এইবার এই কাপটা আমাদের প্রাপ্য ছিলো।  আমাদের কাপ আমরা প্রয়াত ফুটবল ঈশ্বর ডিয়াগো ম্যারাডোনার জন্য উৎসর্গ করলাম। আপনার ব্রাজিলও খারাপ খেলে নাই্ মাত্র এক গোলের ব্যবধান। বাকি সব পরিসংখ্যানে ব্রাজিলই এগিয়ে ছিলো। ব্রাজিলের জন্য শুভকামনা রইল ভাই, আগামী দিনে যেন তারা কাপ নিতে পারে সেই কামনা করি।

আমিঃ ধন্যবাদ ভাই, আপনার আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন এবং শুভ কামনা রইল আগামীতে যেন আরো কাপ নিতে পারে। চলেন ভাই এবার আমরা আমাদের দেশি ফুটবলের দিকে নকটু নজর দেই। এটাকে আরো আপডেট করা যায় কি না ভাবি।

জৈনিক ব্যক্তি ঃ-  তা ঠিক দেশী ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে আমাদেরও কিছু করা উচিৎ। ভাই আমরা এত বেশি ফুটবল প্রেমি কিন্তু এই ১৮ কোটি মানুষের দেশে কি ১১ জন নেই যারা নাকি ফুটবল বিশ্বে আমাদেরকে আবার নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিবে। 

আমিঃ ঠিক বলছেন ভাই, এই বিষয়ে আরেকদিন কথা বলব। চলেন এবার একটা ছড়া পড়ি


ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ভাই ভাই 

খেলার মাঠে হোক লড়াই,

খেলার পরে হাসি খুশি 

এক সাথে দিন কাটাই।


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

১১ জুলাই ২০২১খ্রি.




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ