Ticker

6/recent/ticker-posts

অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও অদ্বৈত মেলা নিয়ে কিছু কথা।


"তিতাস একটি নদীর নাম। কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।

ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে। দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।
তিতাস মাঝারি নদী। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায়না।
তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মত বক্রতা নাই। কৃপণের মত কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করেনা। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্ধেল করে না।" -----
বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস "তিতাস একটি নদীর নাম"। এর রচিয়তা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

তিতাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নদী। এই তিতাসের এক কূলঘেষা গ্রামের নাম গোকর্ণঘাট। এই গ্রামের মালোপাড়ায় ১৯১৪ সালের ০১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন স্বনামধন্য কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ।
তিতাসের গতি-প্রকৃতি ও এর দুই পাড় ঘেঁষে বসবাসকরা মানুষের জীবনাচার, বিশেষত নিম্নবর্ণ মালোদের জীবনের সুখ-দুখঃ, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নিপুণ বর্ণনা সমৃদ্ধ এক ঐতিহাসিক সার্থক উপন্যাস "তিতাস একটি নদীর নাম"। এই উপন্যাসটি তিতাস নদী, তিতাস পাড়ের গ্রাম ও শহর কে পরিচিত করে দেয় বাংলা সাহিত্যের সকল পাঠকের কাছে।
গোকর্ণঘাটের নিম্নবর্ণ মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা ও বেড়ে ওঠা অদ্বৈত মল্লবর্মণ দারিদ্রতার কষাঘাতে খুব বেশি দূর লেখাপড়া করে উঠতে পারেননি। উন্নত জীবন যাপনের আশায় মালোপাড়ার দরিদ্র জেলেরা চাঁদা উঠিয়ে অদ্বৈতকে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জর্জ মাইনর স্কুলে।
পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করার পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে আর বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি জনপ্রিয় এই উপন্যাসিক।
আজীবন সাহিত্যপ্রেমী অদ্বৈত শেষ পর্যন্ত জীবিকার জন্য বেছে নেন পত্রিকার কাজ। কলকাতার "মাসিক ত্রিপুরা পত্রিকা"য় প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
পত্রিকা পেশা থেকে যৎসামান্য যা উপার্জন করতেন তার একটি অংশ সমাজের অসহায় দরিদ্র লোকদের সাহায্যার্থে, একটি অংশের সাহিত্য সেবায়, আরেকটি অংশ দিয়ে জীবন যাপন করতেন মানবিক, ক্ষণজন্মা এই লেখক।
জন্ম ও কর্মে আজীবন সংগ্রামী এই কৃতিসন্তান মৃত্যুর পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছিল অবহেলিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বোদ্ধা ব্যক্তিগণের কাছে অদ্বৈত অমূল্য সম্পদ হলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে অদ্বৈত ছিল অনেকটাই অজানা ও উপেক্ষিত।

অদ্বৈত কে নিয়ে এই ঘাটতি পূরণে কাজ করে যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশকিছু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। "তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ" তেমনি একটি সংগঠন। বিগত প্রায় এক দশক ধরে তিতাস সাহিত্য সাংস্কৃতি পরিষদ "অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মদিন কে উদ্দেশ্য করে বর্ণাঢ্য আয়োজনে তিনদিনব্যাপী অদ্বৈত মেলা করে আসছিল।
করোনা মহামারীর কারণে এ বছর ব্যাপক আয়োজনের অদ্বৈত মেলা নেমে আসে মাত্র ২ ঘন্টার অনুষ্ঠানে। গতকাল ০১ জানুয়ারি বিকেলে স্থানীয় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে বিগত বছরের মতো এ বছরও ছড়া পাঠের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল আমাকে।
দুই ঘন্টার পুরো অনুষ্ঠানটি উপভোগ করলাম মন্ত্রমুগ্ধর মত। অদ্বৈত মল্লবর্মনের জীবনী উপস্থাপনসহ কবি কন্ঠে ছড়া পাঠ, দলীয় কবিতা আবৃতি, লোক সঙ্গীত সহ নানান আয়োজনে সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুনামধন্য জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের স্বাস্থ্যবান্ধব উপস্থিতি অনুষ্ঠান কে করেছে সার্থক। অনুষ্ঠানের বাড়তি পাওয়ার ছিল অতিথিদেরকে পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা।

সব মিলিয়ে ২ ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানটি একদিকে যেমন অদ্বৈত কে করেছিল স্মরনীয় তেমনি ভাবে প্রতিনিধিত্ব করছিল ৩ দিনের মেলা কে। আগামী বছর করোনা মহামারী কাটিয়ে অদ্বৈত মেলা আরো বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে এবং সর্বস্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর ব্যাপক উপস্থিতি হবে এই কামনা ব্যক্ত করছি।
আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব তিতাস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা ও অদ্বৈত মেলার আয়োজক পরিশ্রমই গুণী সংগঠক শ্রদ্ধাভাজন মনির হোসেন ভাইকে এবং তিতাস সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ এর সকল কলাকুশলী শিল্পীদেরকে। যাদের প্রাণান্ত চেষ্টায় সার্থক হয়েছে এই অনুষ্ঠানটি।
পরিশেষে অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি। ধন্যবাদ।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
০২ জানুয়ারি ২০২১ খ্রি.
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ