Ticker

6/recent/ticker-posts

মনের মানুষ: আমার মুভি দেখার গল্প


 

প্রখ্যাত বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত বাউল সম্রাট লালন শাহের জীবনী ভিত্তিক বিখ্যাত উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ পড়েছিলাম প্রায় ১২-১৩ বছর আগে। আমি একটানা যে বইগুলো পড়ে শেষ করেছি এমন বইয়ের সংখ্যা প্রায় শতকের কাছাকাছি। ‘মনের মানুষ’ সেরকম একটি বই। যে সময় আমি এই বইটি পড়ি তখন বই পড়ার একটা নেশা ছিল। প্রায় সব রকম বই পড়তাম বলে হাতের কাছে যা পেতাম- তাই পড়ে ফেলতাম। কিন্তু ‘মনের মানুষ’ হাতের কাছে পেয়েছি বলেই পড়েছি এমনটা নয়। বইটি হাতে আসার আগেই এটি সম্পর্কে জেনেছিলাম যে লালন শাহের জীবনী নিয়ে একটি বই বের হয়েছে। তাই দেখা মাত্রই এটি পড়া শুরু করি। 


যারা পাঠক তাদের জীবনে এমন অনেক বই আছে পড়া শুরু করে আর কখনো শেষ করা হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ সেই বইটি লেখা পাঠককে টানেনি। ‘মনের মানুষ’ আমাকে টেনেছে। শুরু থেকেই উপন্যাসের গল্প যেভাবে এগিয়ে গেছে তাতে পরবর্তীতে কি হয়েছে তা না পড়ে থেমে থাকার উপায় ছিল না। গল্পের নায়ক লালনের ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি, কীভাবে সমাজ তাকে বিচ্যুত করলো, কীভাবে সেই বালক লালন থেকে বাউল হওয়ার পথে এগিয়ে গেলেন, পরে তিনি তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এবং তাঁর সমাজের মধ্যে কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করলেন ও বিভিন্ন সমস্যা পরলেন, সেগুলো থেকে সমাধান কীভাবে আসলো, এভাবে উপন্যাসটির ঘটনা পরম্পরায় এগিয়ে যেতে থাকলো। অনেক বছর আগে পড়া এই উপন্যাসের সবকিছু মনে না থাকলেও মূল ঘটনাসহ কিছু বিষয় মনে গেঁথে ছিল। এর মধ্যে একটি লাইন একবারের জন্য কখনো ভুলিনি- সেটি হচ্ছে ‘শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, কিন্তু মন যদি না জাগে তাহলে কি প্রকৃত মিলন হয়।’ এই লাইনটি কেন যেন গত ১২/১৩ বছরেও ভুলতে পারিনি।


একসময় জানলাম ‘মনের মানুষ’ একটি সিনেমা হয়েছে/ অথবা সিনেমা হওয়ার পরেই হয়ত মনের মানুষ উপন্যাসের কথা জানতে পেরেছি- ঠিক মনে নেই। কিছুদিন যাবত ফেসবুক ভিডিও দেখতে দেখতে মাঝে মাঝেই এই সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য সামনে চলে আসে। একেকবার মনে হয় দেখি। কিন্তু দেখবো দেখবো বলেই দেখা হয় না। আসলে শুধু ‘মনের মানুষ’ না যে সমস্ত গল্প বা উপন্যাস পড়েছি তার নাটক বা সিনেমা দেখার আগ্রহ খুব কমই জেগেছে। এই কারণে দেবদাস থেকে শুরু করে, পদ্মা নদীর মাঝি, হাজার বছর ধরে, তিতাস একটি নদীর নাম, সূর্য দিঘল বাড়ি, লালসালু, কাবুলিওয়ালা, শেষের কবিতার মতো বিখ্যাত বাংলা ছায়াছবিগুলো আমার দেখা হয়নি। আবার এর উল্টোটাও আছে যে-সব ছায়াছবি দেখে ফেলেছি পরবর্তীতে সেসব উপন্যাস সামনে পেলেও আর পড়িনি। যেমন শ্রাবণ মেঘের দিন, দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, হাঙর নদী গ্রেনেড, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ। বলে রাখা ভালো কিছু আছে যেগুলোর উপন্যাসও পড়নি, ছায়াছবিও দেখেনি। সে যাই হোক, কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেছে। আবার ফিরি লালন শাহের কাছে।


গিন্নিকে সাথে নিয়ে ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি দেখলাম। আমাদের বিয়ের পর দুইজনে একত্রে অনেক ছায়াছবি দেখেছি। বলতে গেলে তখন আমার কোনো কাজ ছিল না। একটা চাকরি থাকলেও কয়েক ঘণ্টার নামমাত্র ডিউটি। ডিউটির পর আমি একরকম গৃহবন্দী থাকতাম। সাহিত্য-সংস্কৃতি সাংগঠনিক কাজ থেকে কিছুটা স্বেচ্ছায়, কিছুটা অনিচ্ছায় বিরতি নিয়েছিলাম। লেখালেখিও খুব বেশি একটা করি না। ফলে তখন দিন রাতের বেশিরভাগ অংশই মুভি দেখে কেটে যায় আমাদের। পুরোনো বলে যে-সব মুভি অবহেলায়  এড়িয়ে গেছি সেগুলো খুঁজে খুঁজে দেখেছি। এমন দিন গেছে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি মুভি দেখেছি। আমাদের বিয়ে প্রথম তিন বছরে আমরা প্রায় সার পাঁচশত মুভি দেখেছি। তখন শহরের বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে থাকা বিভিন্ন মুভি কালেকশন নিয়ে এসে কম্পিউটারে বসে বসে দেখতাম। 


প্রথম প্রথম বেশি দেখলেও আমাদের কন্যার আগমনের পর থেকে মুভি দেখা কমে যায়।বিয়ের আগে আমার বৌ শুধু বাংলা ছায়াছবি ছবি দেখতো। আর আমার সাথে বসে সব ধরনের ছবি দেখেছে। বাংলা, হিন্দি, তামিল, হলিউড, ইনারীয়, কোরিয়ান এবং চাইনিজ। দেখতে দেখতে তার মধ্যেও এক ধরনের মুভি দেখার ভূত চেপে বসেছিলো। গত কয়েক বছর হল সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, চাকরি, লেখালেখি আর সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততার কারণে আর কোনো খুব বেশি মুভি দেখা হয় না আমার। আসলে সময় পাওয়া যায় না। তাই ‘মনের মানুষ’ দেখে শেষ করতে দুই দিন সময় লেগে গেলো। আমাদের দুজনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু করে দেখি এই আর কি।


যে কথা বলতেছিলাম- উপন্যাসের পড়া মনের মানুষের গল্প আর সিনেমার ‘মনের মানুষের’ গল্পের কাহিনি এক হলেও দুটি উপস্থাপন ভঙ্গিতে আছে বিস্তর ফারাক। উপন্যাসে যেমন চরিত্রগুলোকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সিনেমাতে তেমনটা করা হয়নি। সিনেমাতে দৃশ্যকল্পকে ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ উপন্যাস এগিয়েছে উপন্যাসের গতিতে, সিনেমা এগিয়েছে সিনেমার ঢংয়ে। উপন্যাসে যেমন অনেক প্রাসঙ্গিকভাবে গান যুক্ত করা হয়েছে। সিনেমাতেও অনেকগুলো গান যুক্ত করা হয়েছে। তবে ঘটনার সাথে গানগুলো এত বেশি প্রাসঙ্গিক যে, পরিচিত গানগুলোকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপভোগ করার এবং প্রকৃত অর্থ হৃদয় অঙ্গন করার সুযোগ রয়েছে। 


ধর্মবিশ্বাস মানুষকে কীভাবে প্রবাহিত করে, অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে কীভাবে মানবিক দিক থেকে বঞ্চিত করে। মানুষ যে সমস্ত আচার-আচরণকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়- একজন সাধু সন্ন্যাসী সেই জিনিস থেকে কি মর্মার্থ উদ্ধার করেন, জীবনের নিগুর রহস্য উদ্‌ঘাটন করেন-সেসব তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে। সমাজ, সংসার, ধর্ম থেকে বিতাড়িত হয়ে একদল মানুষের জঙ্গল বাস তথা বাউল জীবন বেছে নেওয়া এবং বাউলদের মুক্তচিন্তা, নিজস্ব সমাজে তাদের আচরণ, কীভাবে সমাজপতি ও ধর্মীয় গুরুদের আঘাত করে এবং সে স্বার্থান্বেষী নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই উপন্যাস ও ছায়াছবিতে। 


লালন শাহকে নিয়ে রচিত প্রথম উপন্যাস এবং প্রথম মুভি হিসেবে এটি যেমন অসাধারণ, অনন্য একইভাবে এই গল্প আমাদের সামনে প্রশ্ন রেখে দেয় লালন শাহকে নিয়ে আরও গবেষণা করার। উপন্যাস পড়ার ১০-১২ বছর পর মুভি দেখলাম। হয়ত কোনো এক সময় উপন্যাসটি আবার পড়ব। তখন হয়ত ভিন্নরকম স্বাদ উপভোগ করতে পারবে।



যারা মুভিটি দেখতে চান লিংক…..

https://www.youtube.com/watch?v=jurUTziOAvk

যারা পিডিএফ পড়তে চান

https://bengaliebook.com/moner-manush-by-sunil-gangopadhyay/



মনের মানুষ: আমার মুভি দেখার গল্প

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৪ মার্চ ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ