মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া সাহসের কাজ। বিশ্বে অতীতেও পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কিছু উদাহরণ রয়েছে। আমরা জানি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫ সালে ‘নাইট হুড’ পদবি পান, কিন্তু এর চার বছর পর ১৯১৯ সালের ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত এই ‘নাইটহুড’ উপাধিটি তিনি বর্জন করেন। ইতিহাস অনুসন্ধানে পদবি-পুরস্কার বর্জন, ফিরিয়ে দেওয়া বা গ্রহণ না করার বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়।
আজ বাংলাদেশেও একটি সম্মানজনক পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। দেশের ইতিহাসে প্রথম শক্তিমান কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি প্রদত্ত পুরস্কারের এক লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দিলেন। এ ঘটনায় দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি পাড়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। হওয়ারই কথা। বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত লক্ষ্য করলে দেখা যায় স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মত সম্মান জনক পুরস্কারগুলো নিয়ে বেশ হয়েছে হইচই হয়েছে। সকলের মুখে তখন তিনটি আলোচ্য বিষয় থাকে এক. যথাযোগ্য ব্যক্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। দুই. যোগ্য লোককে পুরস্কৃত করা হয়নি। তিন. অযোগ্য লোককে পুরস্কার করা হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ায় সাহিত্য-সংস্কৃতি পাড়া এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদল বলছেন তিনি পুরস্কার ফেরত দিয়ে যথাযোগ্য কাজ করেছেন। কেউ কেউ এ জন্য তাঁকে বাহবা দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন- প্রচলিত অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। কেউ বলছেন- তিনি স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। কেউ বলছেন- তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কেউ বলছেন- সবাই যখন বিভিন্ন নামী-বেনামি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পদক পুরস্কার নেওয়ার পিছনে টাকা-পয়সা খরচ করেন, চেষ্টা তদবির নিয়ে মাঠে নামেন, সেখানে তিনি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার মত মহৎ মানসিকতা দেখিয়েছেন। কেউ বলছেন- প্রচলিত অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন।
আর যারা সমালোচনা করছেন তারা বলছেন ভিন্ন কথা, পুরস্কার প্রাপ্তির ১০ বছর পর তিনি কেনো এই পুরস্কার ফেরত দিলেন ? কেউ অভিযোগ করেছেন- তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য তদবির করেছিলেন এমন গুঞ্জন আছে, তদবিরে পাওয়া পুরস্কার নিয়ে তিনি আত্ম অনুশোচনায় ভুগছিলেন, তাই তিনি তার পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন- ১০ বছর আগে এক লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন এই টাকার বর্তমান বাজার দর আগের তুলনায় কম, সেহেতু তার উচিত ছিল লাভসহ অর্থ ফেরত দেওয়া। কেউ বলছেন- এটি ছেলেমানুষি কাজ, হ্যাংলা পোনা। তার মত বড় লেখকের এসব মানায় না।
কেউ বলছেন- পুরস্কার গ্রহণ পর ১০ বছর যাবত সম্মান গ্রহণ করার পর তা ফিরিয়ে দেওয়া অনৈতিক। নেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে, নাম ঘোষণার পরপরই অস্বীকার করতে পারতেন। কেউ বললেন- ১০ বছর সংসার করার পর বউ তালাক দিলে- সেই স্বামী বা স্ত্রী কেউ আর কুমারী থাকে না। সংসার ভাঙার দোষ দুই পক্ষের থাকে এবং দুই পক্ষই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেউ বলছেন- জাকির তালুকদার চালাক মানুষ। তিনি আলোচনায় থাকার জন্যই তিনি এমন কাজটি করেছেন। একজন বললেন- তিনি এক লক্ষ্য টাকা পুঁজি খাঁটিয়েছেন স্বাধীনতা বা একুশে পদকের মত অন্য কোনো পুরস্কার নেয়ার জন্য।
কোনো পদক বা পুরস্কার পাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে পুরস্কার পাওয়ার জন্য একটি প্রতিযোগিতায় নামেন। এই সমস্ত বিষয়ে অনেক তথ্য প্রমাণও অনেকের কাছে রয়েছে। আবারা এটাও ঠিক প্রকৃত গুণী ব্যক্তিরা পদক-পুরস্কার পাওয়ার জন্য তদবির করেন না। তাদের ক্ষেত্রেও অদৃশ্য এই প্রতিযোগিতা ঠিকই থাকে। কেননা যারা পদক বা পুরস্কার দেন তারা কিছু নিয়ম নীতি ফলো করেন, যাদের পুরস্কার দিবেন তাদের সাহিত্যকর্মের মান যাচাই করেন, ব্যক্তি জীবন নিয়ে খোঁজখবর নেন।পুরস্কার প্রদানকারী কমিটির কাছে অনেকগুলো নামের তালিকা থাকে। যার কিছু নাম থাকে তদবিরের আর কিছু নাম থাকে প্রকৃত গুণী ব্যক্তির। নানা বিষয় চিন্তা ভাবনার পরেই একজন ব্যক্তি পদক বা পুরস্কার পেয়ে থাকেন।
আমরা ধরে নিলাম জনাব জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি পুরস্কার এর জন্য কোনো তদবির করেননি। তিনি যখন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন তখনই তার উচিত ছিল সেই পুরস্কারকে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু ১০ বছর আগে তিনিই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। এই পুরস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, সম্মাননা স্মারক, সনদ গ্রহণ করেছেন। তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায়, রেডিও টেলিভিশনে আলোচনা হয়েছে। ফেসবুকে তিনি মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। গত দশ বছর এই পুরস্কারের জন্য কিছুটা হলেও মানুষের কাছে আলাদা সম্মান এবং মর্যাদা পেয়েছেন। এগুলো তিনি কিন্তু পুরস্কার প্রাপ্ত তালিকার অন্য আরো অনেক ব্যক্তিকে অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় হারিয়েই করেছেন। তিনি যদি এই পুরস্কার তখনই ফেরত দিতেন তাহলে তার জায়গায় আরেকজন হয়ত এই পুরস্কার পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি অন্যজনকে বঞ্চিত করেছেন এখন আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
তিনি একই সঙ্গে তিনি আরো অনেক ব্যক্তির পুরস্কার প্রাপ্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন: বাংলা একাডেমি তার প্রতিষ্ঠান লগ্ন থেকে গত ৭০ বছরে দেশের অসংখ্য গুণী ব্যক্তিকে সম্মাননা প্রদান করেছেন। তারা সবাইতো পুরস্কার ফেরত দেয়নি। তিনি কি তাদের থেকে বেশি সেরা মর্যাদাবান ? তিনি বাংলা একাডেমির নির্বাচন না হওয়ার অজুহাতে এটি করেছেন। তিনি যখন পুরস্কার নিয়েছেন তখনও বাংলা একাডেমির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এখনো হচ্ছে না, তাহলে তিনি কেন তখন নিলেন। এখন যদি একাডেমির মান খারাপ অবস্থানে থাকে তাহলে তখন নেয়া পুরস্কার কেনো ফেরত দিবেন। তার তখনো যদি একাডেমির মান খারাপ থাকে তাহলে তখন কেন নিলেন। এরকম নানা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
এ বছরের সাহিত্য পুরস্কার মাত্র দুইদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছে। উনার উচিত ছিল চলতি বছরের পুরস্কার ঘোষণার আগেই নিজের পুরস্কার ফেরত দেওয়া। তিনি বর্তমান যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবাইকে অযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন। একই সঙ্গে তিনি যে বছর পুরস্কার পেয়েছেন সে বছর তার সঙ্গে আরও অনেকেই বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি তাদের পুরস্কারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বাংলা একাডেমি মান নিম্নগামী হয়েছে বলে তিনি দাবি করছেন, তাহলে একাডেমিতে যারা কাজ করছেন, যারা পুরস্কার পেয়েছেন, ভবিষ্যতে যারা পাবেন। তারা সবাই কি নিম্নমানের, আর তিনি একাই উচ্চাসীন ? জনমনে এই নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার একজন শক্তিমান লেখক। একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার এই পুরস্কার ফেরত দেওয়া সবাই ভালোভাবে নিচ্ছে না। তিনি অনেকগুলো প্রশ্ন সবার সামনে দাঁড় করিয়েছেন ?
পুরস্কার নিয়ে দুটো কথা: পুরস্কার ঘোষণা করে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়। এর কিছু আলোচনা-সমালোচনা সত্যিকার অর্থেই সঠিক। আর কিছু থাকে এখন ব্যক্তিগত ভাবনার প্রকাশ। কেউ হয়ত কোনো পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তির সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তাকে নিয়ে সমালোচনা করেন। কেউ হয়ত নিজের পছন্দের কোনো ব্যক্তি পুরস্কার না পেলে তখন পুরস্কারপ্রাপ্ত সবাইকে নিয়ে সমালোচনা করেন। আবার কেউ নিজের পরিচিত পছন্দের কোনো লেখকের পুরস্কার প্রাপ্তিতে আনন্দিত খুশি হন।
তবে এ কথা ঠিক সবাইকে জিজ্ঞেস করে পুরস্কার দেওয়া যায় না। সবাইকে জিজ্ঞেস করতে গেলে একটি বিরাট গোল মেলে পরিস্থিতির শিকার হবে। এই জন্যই পুরস্কার কমিটি একটি নিয়ম ফলো করে এবং ফলো করা উচিত। বাংলা একাডেমি অথবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সেই সমস্ত নিয়ম কি হতে পারে, এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা থাকতেই পারে। মান উন্নয়নে আলোচনা হতে পারে। অযোগ্য কেউ পুরস্কার পেলে তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ১০ বছর পর পুরস্কার ফেরত দেওয়ার এই কাজটি অনেকের মতেই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। তবে এই কর্মটির মাধ্যমে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকবেন এটাই সর্ব সিদ্ধ এবং ভবিষ্যতে কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান তাকে অথবা অন্য কাউকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়া সাহসের কাজ। কিন্তু…অনেক গুলো প্রশ্ন তৈরি করে পুরস্কার ফেরত দেওয়া কি ঠিক। এই প্রশ্নটিই এখন সবার কাছে।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
২৮ জানুয়ারি ২৪
0 মন্তব্যসমূহ