Ticker

6/recent/ticker-posts

ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা ও হিজড়া বির্তক এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি


 

ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা ও হিজড়া বির্তক এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতা এই দুটি বিষয়কে ব্যক্তিগতভাবে আমি অপছন্দ করি। দেশের আইনে যদি এর স্বীকৃতিও দেয় তবুও এগুলোকে অপছন্দ করব। কোনো ধর্মে যদি এর বৈধতা থাকে তবুও এগুলোকে অপছন্দই করব। কোনো কিছুকে পছন্দ বা অপছন্দ করার এতটুকু স্বাধীনতাতো মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেব প্রত্যেকেরই থাকেই। শুধু আমি কেনো আমাদের দেশতো বটেই পৃথিবীর যেকোনো দেশের বেশিরভাগ নাগরিকই ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতাকে অপছন্দই করবে। যদিও কোনো কোনো দেশে এগুলোর আইনত বৈধতা রয়েছে। কিন্তু খুব সামান্য মানুষই এগুলোকে পছন্দ করে বা করবে।

সম্প্রতি আমাদের দেশে এই দুটি বিষয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানবইয়ের ‘শরীফার গল্পশীর্ষক একটি গল্পে ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতা রয়েছে উল্লেখ করে পাঠ্য বইয়ের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ করেছেন। সেই ভিডিওটি দেখার পর থেকেই আমি উৎসুক হয়েছি কী লেখা রয়েছে সেই বইয়ে, যাতে তিনি পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ করেছেন এবং অন্যদের এই প্রতিবাদ করতে আহ্বান করেছেন।ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সেই বইয়ের পাতাও ভাইরাল হয়েছে।গত দুদিনে আমার সমানে যতগুলো এরকম পোস্ট এসেছে তার সবকটিই আমি পড়েছি।

সেই গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে ঐ শিক্ষক না বুঝেই এমনটা করেছেন অথবা বুঝেই কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে থেকে এমনটা করেছেন। সংশ্লিষ্ট শরিফার গল্প (শরিফ থেকে শরিফার গল্প) ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতাকে মোটেই প্রমোট করা হয়নি। সেখানে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কথা বলা হয়েছে। যারা জন্মগত শারীরিক লৈঙ্গিক ত্রুটি নিয়ে বড় হন। যারা আমাদের সমাজে এক রকম অবহেলিত।যারা শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অথচ তারা আমাদের মতই মানুষ।সম্প্রতি সরকার তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের অনেকে এখন নানা পেশায় সফল। স্বাভাবিক মানুষের মত তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এই কথাগুলোই সেখানে বলা হয়েছে বা বলবার চেষ্টা করা হয়েছে। এতো দোষ কোথায় তা আমি বুজতে পারছি না।তাছাড়া সেখানে ট্রান্সজেন্ডার বা সমকামিতার কথা কোথায় বলা হয়েছি তাও আমি খুঁজে পাইনি। শরিফার গল্পটি পড়ে বুঝেছি যে, হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব দূর করাই এ পাঠের মূল উদ্দেশ্য।

তবে একথাও ঠিক যে গল্পটি ততটা সাবলীলভাবে উপস্থাপনা করা হয়নি।যেমন সেখানে একটি লাইন আছে কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। এ বাক্যটি এভাবে না উল্লেখ করে এখানে বলা উচিত ছিল ছোট থেকে আমি ছেলে হয়ে বড় হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার মধ্যে অনেক মেয়েলি শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আমি মেয়েদের মত চলাফেরা করতাম, কথা বলতাম এবং তাদের ব্যবহার জিনিস ব্যবহার করতে চাইতাম। আরেকটি বিষয় ছিল শরিফ হঠাৎ করেই আরেকজন হিজড়ার দেখা পেয়ে, তার কথা শুনে তার কাছে চলে যায় এবং তাদের দলে গিয়ে এখানেই থাকতে শুরু করে। এই এখানে তাদের কাছে যাওয়ার আগে তার হিজড়া হওয়ার কারণে স্কুল জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল এই সমস্ত বিষয়ে উল্লেখ করার দরকার ছিল। তাহলে একটি স্বাভাবিক পরিবার থেকে বড় হওয়া ছেলে হিজড়া হওয়ার কারণে হিজড়া পরিবারে যাওয়ার কারণটা সহজেই শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারতো। তাছাড়া বইয়ের বিগত সংস্করণ তৃতীয় লিঙ্গের স্থানে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি উল্লেখ থাকায়ও বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যদিও এই বছরের সংস্করণে তার সংশোধন করা হয়েছে।

তবে সব মিলিয়ে বিষয়টি এতটা জটিল নয় যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এটার সারমর্ম বুঝতে ব্যর্থ হবেন। সেই শিক্ষক এ বিষয়টি শুধু বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন তা নয় বরং তিনি গোটা দেশের মানুষকে ভুল বুঝিয়েছেন, বোঝাতে চেষ্টা করেছেন এবং একটি অনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন নিজের মতের অমিল হলেই ভিন্নমতের বই বা প্রকাশনা ছেঁড়া যায়। আমরা দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননা করে এর পাতা ছেঁড়া হয় বা আগুনে পুড়ে ফেলা হয়। এসব কি আমরা মন থেকে সমর্থন করি? অবশ্যই করি না। আমরা বিশ্বাস করি তারা কোরআন পড়েনি বা বুঝতে পারিনি বলেই কুরআন অবমাননার মত দুঃসাহস দেখিয়েছে। শিক্ষক আসিফ কি আমাদেরকে এ বার্তাই দিতে যাচ্ছেন? পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষ নিজ ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোকে সত্য এবং পবিত্র মনে করে এবং অন্য ধর্মগুলোকে মিথ্যা এবং অপবিত্র মনে করে। জনাব আসিফ কি আমাদেরকে বুঝাতে চাইছেন যে, তুমি যা অপছন্দ করো তা ছিঁড়ে ফেলা প্রতিবাদের অংশ। এমনটা হতে হলে তো পৃথিবীতে কোনো ধর্মগ্রন্থ বা মতাদর্শের বই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা মতাবলম্বীদের আক্রমণের শিকার হত।

ভিডিও বক্তব্যে আসিফ মাহতাব বইটিকে বাজার থেকে কিনে পাতা ছিঁড়ে আবার ফেরত দিতে বলেছেন। এখানে তিনি একটি মূর্খের মতো কথা বলেছেন, পাঠ্যবই বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। পাঠ্য বই রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এটি ছেঁড়া কখনোই সুনাগরিকের কাজ হতে পারে না।বই ছিঁড়ে, পুড়িয়ে প্রতিবাদ করা মুর্খদের কাজ, শিক্ষিত মানুষ প্রতিবাদ করবে স্মার্ট উপায়ে।সেই উপায়টা কি সেটা বুজতে পারাইতো জ্ঞান। সে জ্ঞান কি আদৌ আসিফ সাহেবের আছে?

পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক এ দেশে নতুন নয়।বইয়ের কোনো পাঠ্য বা বিষয়ে দ্বিমত থাকলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে।এসব আলোচনা-সমালোচনার ভিত্তিতেই অতীতেও পাঠ্যবই সংশোধিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু পাঠ্যবই ছেঁড়ার মতো হীন জঘন্য কাজ এই দেশে সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। এজন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত।তা নাহলে ভবিষ্যতে কারো কোনো বিষয় ভালো না লাগলেই তিনিই বই ছিঁড়বেন।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ধর্মের, মতের, শ্রেণির, পেশার ও লিঙ্গের লোক এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসেন, আসবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত থাকে, থাকবে। ফলে এখানে যারা লেখাপড়া করে তারাও একটি উন্নত মানসিকতা নিয়ে লেখাপড়া করে, করবে।এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হবেন তাদের চাইতে আরো বেশি উন্নত মানসিকতার। কিন্তু জনাব আসিফ বুঝে হোক আর না বুঝে হোক অত্যন্ত নিম্ন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের প্রতি তার লিঙ্গ বৈষম্য, কুৎসিত মনোবৃত্তি, বিদ্বেষ এবং হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে আমি মনে করি।

বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে এখানে কোনো এক ধরনের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে পারবেন, ভিন্ন ধরনের লোকেরা পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে যারা শিক্ষকতা করবেন তাদেরও এমন মানসিকতাও উন্নত রাখতে হবে। আসিফ মাহতাব এই বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার সাথে সাথে তার ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন ছবিও ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে তার দ্বিচারিতার মনোভাব সুস্পষ্ট। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডারের বিরোধিতা করলেও মদ নারী বিষয়ে তার দুর্বলতা সংশ্লিষ্ট ছবিগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে। এসব বিষয়ে তার ভণ্ডামি প্রকাশ পেয়েছে বলে আমি মনে করি। তার কিছু লেখার স্ক্রীসট দেখে মনে হলে তিনি ভালো বাংলা বোঝেন না। বাংলা না বুজলে পাঠ্য বইয়ের লেখা ভুল বোঝাই স্বাভাবিক।

এই শিক্ষকের বার্তা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা একক অথবা দলগতভাবে সংশ্লিষ্ট বইয়ের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গিয়েছে। এতে অবশ্য আমি অবাক হইনি। কারণ তারও আসিফ সাহেবের মত ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গের পার্থক্য বুজতে পারেনি। আমাদের দেশের মানুষ হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞান রাখার চাইতে বেশি ধর্মান্ধতা বেশি পছন্দ করে। ভালো মন্দ যাচাই না করেই কারো বক্তব্যকে শুধু ধর্মীয় কারণে স্বীকার করে নেয়। ফেসবুকের বিভিন্ন ছবি, ভিডিওর সত্য মিথ্যা পার্থক্যই ধরতে পারে না। মিথ্যা ছবি ভিডিওতেও আমিন, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ লিখে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট করে। তারা যে এরকম একটি বিষয়ে বই ছিঁড়াটিকে ভালোভাবেই নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এসবের জন্য ওই শিক্ষকের দায়ী করা উচিত।

আমাদের দেশে প্রতিবছরই পাঠ্য বইয়ের নানা অসংগতি নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছর ধরে এসব বিতর্ক দেশের পাঠ্যবইয়ের পিছু ছাড়ছে না। জাতীয় পাঠক্রম এসব বিষয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করি। পাঠ্য বইয়ে বিষয় নির্বাচন, ছবি সংযোজন, ও বাক্য গঠনে আরো যত্নশীল হতে হবে। আমার মনে হয় প্রতি বছর পাঠ্য ছাপানোর আগে তার পাণ্ডুলিপি ওয়েব সাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রয়োজন। এতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষ কোনো বিষয়ে ভুল বা অসংগতি পরিলক্ষিত হলে সেসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবেন। ফলে এনসিটিবি বই ছাপানোর পূর্বেই সংশ্লিষ্ট বিষয় সংশোধনযোগ্য মনে হলে সংশোধন করে নিতে পারবেন। এতে বই প্রকাশের পর বির্তক অনেকটাই কমবে।

আবারও বলছি ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আমিও ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতার বিরোধী। কিন্তু হিজড়া বা তৃতীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে। কারণ তারা আমাদের মতই মানুষ। আমাদের মত তারাও কারও না কারো সুস্থ স্বাভাবিক পরিবারে তাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আপনার আমার পরিবারে জন্ম নিতে পারে কোনো তৃতীয় লিঙ্গের শিশু। আমাদের দেশে একসময় প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিও খারাপ মনোভাব পোষণ করা হতো। তাদের অপয়া, অশুভ মনে করা হতো। তারা স্বাভাবিক শিশুর মত সমান সুযোগ পেতো না। এখন সময় পাল্টেছে, মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টেছে। হিজড়াদের নিয়েও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একসময় ঠিকই পাল্টাবে। হিজড়াদের জন্য একটি সহনশীল সমাজ গড়ে উঠলে, আমাদেরই পরিবারে যদি কোনো শিশু হিজড়া শিশু জন্ম নেয় তাহলে সেও একটি সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারবে। তাই আসুন সকলে কোনো বিষয়ে পক্ষে যা বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জেনে বুঝে তারপরে পক্ষ অবলম্বন করি।

  

লেখক: মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, পরিচালক-ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক কিচিরমিচির।

২৪ জানুয়ারি ২৪

mishrabon@gmail.com /01717-095751


সারাবাংলা ডটনেটে প্রকাশিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ