Ticker

6/recent/ticker-posts

টিপ কাণ্ডে বাঙালির বিভাজন

 

টিপ কাণ্ডে বাঙালির বিভাজন

আমরা যতটা ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করি, ঠিক ততটা মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি না !

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

ডিম ভাঙতে হবে ডিমের চিকন অংশ দিয়ে নাকি মোটা অংশ দিয়ে- এই নিয়ে দুই রাজার মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। তাদের কথোপকথন একসময় তর্কে রূপ নেয়, সেই তর্ক শেষমেশ গড়ায় যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে অংশ নেয় দুই দেশের হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত। যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল অনেক বছর। মারা গেছে প্রচুর মানুষ।

বলছিলাম অ্যাংলো-আইরিশ লেখক ‘জোনাথন সুইফট’ রচিত বিখ্যাত ধ্রুপদী সাহিত্য ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এর ক্ষুদে মানব সম্প্রদায় লিলিপুটদের যুদ্ধের কথা। সাহিত্যের সেই কাল্পনিক লিলিপুটদের দেশ যেন এখন আমাদের বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষ এখন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে। আদার ব্যাপারির নাকি জাহাজের খবর নিতে নেই, তাই এই দেশের মানুষ ডিমের মতো এত বড়সড়ো বিষয়ের দিকে আর যেতে চায় না। ডিমের ভিতর থাকা কুসুমের অন্তত বিশ ভাগের এক ভাগের সমান ক্ষুদ্র টিপ নিয়েও তারা তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে। এই নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেলেও অবাক হবো না। গত কয়েকদিন টিপের পক্ষে-বিপক্ষে এত যুক্তি-তর্ক, বর্ণনা দেখে শুধু আমি কেন; যে কারো একথাই মনে হবে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষের খবর তো এই দেশে নতুন কিছু নয়।

সামান্য একটি কালো বিন্দুর মধ্যে যেন বাঙালির রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম আটকে গেছে। টিপ পড়লে বাঙালির ধর্ম চলে যায়। টিপ না পড়লে বাঙালির সংস্কৃতিও ঠিক থাকে না। রাজনীতির অন্যতম ইস্যু এখন টিপ। সংসদ থেকে চায়ের দোকান- সব জায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু এখন ছোট্ট এই টিপ। এই নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদরা টিপ নিয়ে রাজনীতি করছেন, ধর্মপ্রাণ-ধর্মজীবীরা টিপ নিয়ে ধর্মীয় বানী শোনাচ্ছেন।

সংস্কৃতিকর্মীরা টিপ নিয়ে আরো বেশি সরব, কয়েকজন কবি টিপ নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছেন। গীতিকার লিখেছেন গানও। বড় বড় সংবাদপত্রের ধারাবাহিক শিরোনাম এখন টিপ। বাঙালি নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশের চিরায়িত অনুষঙ্গ এই টিপের অপমানে কয়েকজন পুরুষ টিপ পরে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। করেছেন মানববন্ধন। ছাপান্ন হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশাল এলাকার মানুষ সব কিছু ফেলে এখন ব্যস্ত সামান্য দশ পনেরো মিলিমিটার ব্যাসার্ধের টিপ নিয়ে। বঙ্গদেশে ‘তিলকে তাল করার’ প্রবাদ বচনটি টিপ কাহিনীর সত্যিকার উদাহরণ।

বাঙালির ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকে টিপ আলোচনায় এসেছে বহুবার। কিন্তু টিপ এইবার তার নিজের পূর্বেকার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হাজার বছর অবহেলায় থাকা টিপ যেন এবার আমাদের বলছে ‘ক্ষুদ্র বলে কাউকে অবহেলা করতে নেই’। টিপ কাহিনীর সাথে সাথে আমার মনে অনেক বছর ধরে উঁকি দেওয়া একটি প্রশ্ন উত্তর পেয়ে যাই। কী কারণে বাঙালিদের হাজার বছর বিদেশি শাসনের করাল গত হতে হয়েছে? পাকিস্তান, ব্রিটিশ, মোগল, পর্তুগিজ, ওলোন্দাজরা কেন হাজার বছর ধরে বাঙালিদের শাসন-শোষণ করেছে? উত্তর হচ্ছে- যে বাঙালিকে সামান্য টিপ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় তাদেরকে শাসন-শোষণ করা খুব কঠিন কিছু নয়!

টিপ পড়ায় ধর্মীয় বিধি নিষেধ আছে কি নেই বা টিপ পড়ার প্রচলন কোথায় থেকে শুরু হলো বাঙালি নারীরা তা কোন কালেই খুঁজতে যায়নি। বাঙালি নারীরা টিপ পরে সৌন্দর্য চর্চার অংশ হিসেবে। আমাদের মা-খালা, দাদি-নানি ছোটবেলায় নিজেরা টিপ পড়েছেন, বড় হয়ে আমাদের ছোটবেলায় আমাদের কপালে কাজল কালো টিপ এঁকে দিয়েছেন। আমাদের বোন, বউ বা কন্যারাও একই কাজ করে। কিন্তু এই টিপ পড়ায় ধর্ম খুঁজতে গিয়ে বেঁধেছে যত বিপত্তি। 

ধর্ম খুব স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্মের মানদণ্ডে কোনো কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলতে যাওয়ার আগে তাই ভালোভাবে জেনে শুনে বুজে বলা উচিত। তা নাহলে বাঙালি ধর্ম নিয়ে বিরাট কোনো অধর্ম করতে একদণ্ডও পিছপা হবে না। যদিও নিজে ধর্মের অন্য সকল বিধি-নিষেধ ভালোভাবে পালন করুক বা না করুক জোর সে করে অন্যকে ধর্ম পালন করিয়েই ছাড়বে। আবার ধর্মের নামে হাজার পাপ করেও তারা মোটেও অনুশোচনায় ভোগে না, বরং পুণ্য বা সওয়াব মনে করে।

ধর্মের ধর্মের উৎপত্তি ও শক্তির মূল উৎস হলো বিশ্বাস। এই বিশ্বাস শক্তি এতটাই বেশি যে মানুষ অদৃশ্য আল্লাহ, ভগবান তথা অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার ওপর অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস আনে এবং অদৃশ্য ইহলোকিত জীবনকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট সত্যি হিসেবে মেনে নেয়। তখন তাদের কাছে ইহলৌকিক জীবন আচারের ভালো-মন্দ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো তাদের কাছে নিতান্তই গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ধর্ম বিশ্বাসই তখন তাদের কাছে একমাত্র মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন জ্ঞান, নৈতিকতা, মানবতা এবং মূল্যবোধের সংযোজন না ঘটে তখন ধর্ম হয়ে যায় সমাজে অশান্তি-অরাজকতার সৃষ্টি করার মারাত্মক এক অস্ত্র। যুগে যুগে এর অংশ প্রমাণ আছে। তাই টিপ বা এ জাতীয় গৌণ বিষয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে যাওয়া এই দেশে অসম্ভব কিছু নয়। তাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্চা ও রক্ষা করার পাশাপাশি ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করার দিকে অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত। কেনান আপাতত দৃষ্টিতে আমরা যতটা ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করি, ঠিক ততটা মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি না।

কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতাংশের কথা মনে পড়ে যায়- “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।” মাঝে মাঝে ভাইরাল হওয়া আমাদের ছোট ছোট মানসিকতাগুলো দেখে মনে হয় সত্যিই তো আমরা এখনো মানুষ হতে পারিনি। মানুষ হলে আমাদের মধ্যে এত বিভাজন কেন ? মনে হয় আকারে আমরা লিলিপুট না হলেও মানসিকতার দিক দিয়ে আমরা টিকই লিলিপুট।

একজনকে দেখলাম লিখেছে সৃষ্টিকর্তাও টিপের পক্ষে, তিনি সূর্য ও চাঁদ দিয়ে আকাশের বুকে টিপ একে দিয়েছেন। (রসিক বাঙালি; পারেও বটে) চাঁদ, সূর্য আকাশের বুকে একটি টিপ হয়ে শতশত গ্রহ নক্ষত্র সমৃদ্ধ বিশ্ব জগৎকে সুশৃঙ্খলিত করে রাখলেও কারো কারো কপালের একটি সামান্য টিপ লাল-সবুজের বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষকে বিভক্ত করে ফেলতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগে। লাল-সবুজের কথা মনে হতেই মনে পরলো আমাদের পতাকাতেও সবুজ এর মাঝখানে একটি লাল টিপের কথা। ১৯৭১ সালে দেশকে ভালোবেসে নিজেদের রক্ত দিয়ে যে টিপে এঁকে দিয়েছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে আমাদের এতো বিভাজন দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, মুক্তিযুদ্ধ যদি এই সময় হতো তাহলে আমরা কি বিজয়ী হতে পারতাম ! নাকি পৃথিবীর অনেক দেশের মত গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকতো।

পরিশেষে বলতে চাই- আপনি ছেলে-মেয়ে যাই হোন, যে কোনো ধর্মের, দলের, মতের হোন, টিপের পক্ষে-বিপক্ষে হোন, কপালে টিপ পরেন আর নাই পরেন, বুকের মাঝে আমাদের পতাকার লাল টিপকে স্থান দিলে শুধু টিপ কেন কোনো কিছুই বাঙালি হিসেবে আমাদের বিভাজন করতে পারার কথা না। তাই দেশকে ভালোবাসুন, দেশের মানুষকে ভালোবাসুন। তাছাড়া একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তার কৃষ্টি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাসের প্রতি আমাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকার কথা। যে শ্রদ্ধাবোধ অন্যদের কাছ থেকে আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য আশা করি। তাই দাড়ি, টুপি, তসবি, পাঞ্জাবি, বোরখা, হিজাব, টিকি, পৈতা, ধুতি, টিপ, তিলক, শঙ্খ, শাখা, ক্রুশ ইত্যাদি কোন ধর্মী প্রতীক বা চিহ্নসহ অন্য যেকোনো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কারো সাথে তর্কে-বিতর্কে জড়ানোর পূর্বে আসুন- ‘সবার আগে আমরা মানুষ হই, মানবিক হই’।

৬ এপ্রিল ২০২২ খ্রি. ব্রাহ্মণবাড়িয়া


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

পরিচালক-ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-কিচিরমিচির 

লোকনাথ দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া


(দৈনিক সরোদ ও মাছরাঙা মাতঙ্গী সংখ্যায় প্রকাশিত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ