Ticker

6/recent/ticker-posts

রক্ষা করো প্রভু, আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর পৃথিবী দাও

 

রক্ষা করো প্রভু, আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর পৃথিবী দাও

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

রূপময় বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এই দেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিকগণ লেখার উপজীব্য সংগ্রহ করেন প্রকৃতি থেকে। ফুল-ফল, পশু-পাখি, গাছগাছালি, লতাপাতা, পাহাড়-পর্বত, নদী-ঝর্ণা, আকাশ-চন্দ্র-সূর্য-তারা প্রভৃতি লেখার প্রাকৃতিক উপকরণ। প্রকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশি লেখকদের লেখার অন্যতম বিষয় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র। এসব ছাড়াও লেখার প্রধানতম বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ। মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না, জীবনবোধ, প্রেম-ভালোবাসা, লড়াই-সংগ্রাম, কৃষ্টি, ইতিহাস-ঐতিহ্য লেখার মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। 

প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পার হয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্য এভাবেই চলে এসেছে। পার্থক্য হয়েছে শুধু মাত্র ভাষার প্রয়োগ আর ব্যবহারে। ভাষার উত্তরাধুনিক যুগ ধরা হয় একুশ শতাব্দীকে। এই শতাব্দীর শুরুতে ভাষার আধুনিকতা কিছুটা বজায় থাকলেও প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সহজ লভ্যতার কারণে লেখার মাধ্যম, একদিকে যেমন কাগজ কলম ছেড়েছে, সেই সাথে লেখার উপজীব্য বিষয়ও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। একসময়ের খ্যাতিমান ও জনপ্রিয়  বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের লেখকদের সবাই প্রকৃতি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষ নিয়ে তাদের সাহিত্য রচনা করেছেন। 

উত্তরাধুনিক যুগের সাহিত্যে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন নিয়েছে কলমের জায়গা। ওয়েবসাইট ও ওয়েব পেজ নিয়েছে বই-খাতার জায়গা। বড়ো বড়ো সাহিত্যকর্ম এখন খুব বেশি একটা হয় না। এই যুগে ছোট ছোট সাহিত্যের জনপ্রিয়তা খুব বেশি। দু’তিন লাইনে মানুষ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে আধুনিক সব মাধ্যমে।

আগেকার যুগের লেখকগণ ছিলেন হয়ত উচ্চ শিক্ষিত, নয়তো প্রচুর জীবনবোধ থেকে স্বশিক্ষিত। আজকাল লেখক হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা বা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত স্বশিক্ষার খুব বেশি দরকার হয় না। প্রযুক্তির ব্যবহার জানলে যে কেউ হতে পারেন লেখক। তাই ভাষা পণ্ডিতগণ বলেন- ডিজিটাল মাধ্যমে লেখা বাড়লেও মানসম্মত তেমন কোনো সাহিত্য বের হচ্ছে না।

এই যুগের সব চেয় বড় একটা পরিবর্তন হলো প্রকৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এখন আর তেমন একটা সাহিত্য রচনা হয় না। এখন মানুষের লেখার আর সাহিত্য রচনার মাধ্যম হলো শুধুই মানুষ। এর মধ্যেও আবার কথা আছে। এখন মানুষের ইতিবাচক সবদিকে লেখা যথেষ্ট কম তৈরি হয়। বেশি লেখা হয় মানুষের নেতিবাচক দিক নিয়ে। ইতিবাচক যা কিছু তার বেশিরভাগ আত্মকেন্দ্রিক। 

তাইতো নানান মাধ্যমে আমাদের লেখায় প্রেম-ভালোবাসার জায়গা নিয়েছে পরকীয়া, ধোঁকা আর মানুষ ঠকানো। মানুষের জন্য মানুষের জীবন বাঁচানোর অসাধারণ গল্পের কাহিনি আজ চাপা পড়ে মানুষ মানুষের জীবন নেয়ার অসংখ্য গল্পে। ভাষার জন্য, দেশ-জাতীর জন্য জীবনবাজি রাখার ইতিহাস চাপা পড়ে নিজস্ব স্বার্থে বিশাল বিশাল দুর্নীতির ইতিহাসে। পারস্পরিক সহযোগিতার ছোট ছোট গল্পগুলি হারিয়ে যায় সর্বত্র অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার গল্পের ভিড়ে। সুন্দর পোশাক, সুন্দর মুখশ্রী উপস্থাপনে ব্যস্ত মানুষ এখন আর সুন্দর মনের কবিতা লেখে না, পড়ে না। 

গাছের ডালে ঝুলন্ত অসহায় নারী শিশুর লাশ আর পেরেক ঠুকানো বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড দেখে এখন আর গাছ নিয়ে জন্ম হয় না কোন কবিতা। পুকুর-ডোবা ভরাট, নদীর জল দূষিত, কী করে লেখা যায় মাছ বা নদীর ছড়া। তার উপর নদীতে নৌকা লঞ্চ ডুবে ভেসে উঠে মানুষের লাশ। সুরম্য অট্টালিকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া থেঁতলানো শরীর। গাড়ির চাকায় পৃষ্ট দেহ আগুনে পোড়া কুৎসিত তনু বা মাটি চাপা দেয়া বীভৎস পচা লাশের দুর্গন্ধে বসে বসে আর লেখা যায় না সুরজ-সখিনা, প্রমিলা-প্ররিতোষ সুখের সংসারের কোন উপন্যাস। যে শিশু জীবন কী, শরীর কী তা বোজার আগেই পাশবিক নির্যাতনে স্বীকার হয়, যার খণ্ডিত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যে দেশের নালা-নর্দমা, বন-জঙ্গলে, সে দেশে কী করে রচিত হবে দারুণ কোনো শিশু সাহিত্য।

আমাদের লেখায় এখন তাই গুম, খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা, দুর্নীতি আর অনিয়মের ছোট বড় আখ্যান। ইট-পাথরের ঘর-বাড়ি, লোহা-লক্করের কারখানা আর যানবাহনে গ্রামের মেঠো পথ হারিয়ে গেছে সেই কবে, কী করে গাই আমরা গরুর গাড়ির গান। 

মানুষে মানুষে বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, ভরসা নেই, ভালোবাসা নেই। নেই প্রাণ খোলা হাসি। তাই বাংলা ভাষার এই উত্তর আধুনিকতায় নেই গর্বের ইতিহাস, বুকে লালনের ঐতিহ্য, সবাই মিলে মহাসমারোহে পালনের কোন কৃষ্টি। 

এই সভ্যতা, এই আধুনিকতা, প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতা আমাদের আরামদায়ক জীবন দিয়েছে। কিন্তু স্বস্তিদায়ক মন দিতে পারেনি। নিরাপদ খাদ্য, ওষুধ আর নিরাপদ জীবন দিতে পারেনি। দেশে একের পর এক ঘটে যায় আলোড়ন সৃষ্টি করা নেতিবাচক সব ঘটনা। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কার পক্ষে লিখব আর কার বিপক্ষে লিখব,  কি লেখা বৈধ, কি লেখা অবৈধ। লিখে আবার কী বিপদে পড়ি। কি লিখব আর কি লিখব না, এসব ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। কি করে আমাদের নতুন প্রজন্ম লিখতে পারবে বাংলা সাহিত্যের নতুন কোনো অমর সাহিত্য।

রূপকথার রাক্ষস-খোক্ষস, জিন-পরি, দেও-দানবের গল্প শুনে বড় হয়েছি আমরা। আর আমাদের সন্তানরা বড় হয় মানুষ নামক রাক্ষস-দানবের ছবি আর ভিডিও দেখে। তাই বিশ্বজগতের অধিকর্তার কাছের আমাদের প্রাত্যহিক প্রার্থনা “আমাদের রক্ষা করো প্রভু, আমাদের নিরাপদে রাখো। আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর পৃথিবী দাও”।


মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

পরিচালক-ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-কিচিরমিচির।

০১৭১৭-০৯৫৭৫১


রচনা: ২১ জুলাই ২০১৯


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ