Ticker

6/recent/ticker-posts

জল্লাদ

প্রায় ৩২ বছর পর আজ জেল থেকে বের হন জল্লাদ শাহজালাল (ছদ্ম নাম)  ডাকাতি, হত্যা অস্ত্র মামলায় ৪২ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে ১৯৯১ সালে জেলে ঢুকেছিল সে বের হয়েছে জল্লাদ হয়ে জেলে সুযোগ পেয়েছিল এই ভয়ংকর কাজ করার কারা কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি, একটু ভালো থাকা আর নিজের সাজা কম করায় আশায় রাজি হয়ে গিয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিগত তিন দশকে দেশের হাই প্রোফাইল মামলার ২৬ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশের আলোচিত ব্যক্তি সে নামের সাথে জল্লাদ বিশেষণ যুক্ত হয়েছে সে কারণেই

জেলকোড অনুযায়ী কারাগারে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করায় সাধারণ রেয়াত এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করায় বিশেষ রেয়াত মিলিয়ে মোট ১০ বছর মাস ২৮ দিনের মতো সাজা মওকুফ পেয়েছে সে সবমিলিয়ে ৩১ বছর মাস ৩২দিন তথা জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে তারা জেলে বিয়ে না করায় তার ঘরসংসার ছিল না ফলে ৭৪ বছর বয়সি শাহজালাল জেল থেকে বের হয়ে উঠেছে জেলে পরিচিত হওয়া এক বন্ধুর বাসায়

পথে যেতে যেতে শাহজালাল ঢাকা শহর দেখে, বাংলাদেশ দেখে ভীষণ অবাক হয় চারিদিকে কত পরিবর্তন উঁচু উঁচু দালানকোঠা, দারুণ দারুণ ডিজাইনের বাড়িঘর, বড় বড় রাস্তা- ব্রিজ রাস্তা ভর্তি নানান রকম যানবাহন মোবাইল, টিভি, কম্পিউটারসহ আধুনিক কত যন্ত্রপাতি বিশাল বিশাল কলকারখানা চারিদিকে রং-বেরঙের পোশাক পরা কত বিচিত্র মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বাংলাদেশকে সে জেলের বাইরে রেখে গিয়েছিল, সেই বাংলাদেশ এখন আর নাই !

শাহজালাল নিজেই নিজেকেই তিরস্কার করতে থাকে লোভ, হিংসার বশবর্তী হয়ে করা ৩০ বছর আগে করা এক অন্যায়ের কারণে এতো বছর জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী থাকতে হয়েছে কত সুন্দর এই পৃথিবী, কত নান্দনিকতায় ভরপুর চারদিক ! সুখের এত আয়োজন- সবকিছু থেকে বঞ্চিত হতে হলো তাকে শাহজালাল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এই সুন্দর দেশ দেখে দেখে কয়েক মাস; এমনকি কয়েক বছর পার করে দেবে তারপর ছোটখাটো কোনো কাজ করে, সৎপথে থেকে, ধর্ম-কর্ম করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই

কয়েক মাস পর

জেলের বাইরের জীবন, প্রকৃতি জল্লাদ শাহজালালের আর ভালো লাগছে না তার মনে হতে লাগলো জেলের ভিতরেই সে ভালো ছিল বাহিরের এত জঞ্জাল জেলের ভিতরে ছিল না এতো মারামারি-হানাহানি, চুরি-ছিনতাই, খুন-ধর্ষণ, দুর্ঘটনা-দুর্নীতি জেলের ভিতরে ছিল না বাহিরের এত অমানুষ-অশান্তি জেলের ভিতর ছিল না থাকা-খাওয়ার এত অনিশ্চয়তা জেলের ভিতরে ছিল না মানুষ মানুষকে ঠকানোর মহোৎসব জেলের ভিতরে ছিল না

শাহজালাল মনে মনে ভাবে- আমি আর কত বড় জল্লাদ! দেশের আনাচে কানাচে লাখো লাখো জল্লাদ ঘুরে বেড়ায় হাট-বাজার, ব্যাংক-বিমা, অফিস-আদালত, বিদ্যালয়-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, হাসপাতাল সবখানেই মুখোশধারী অসংখ্য জল্লাদ ঘুরে বেড়ায় তাদের নামের আগে পরে অবশ্য জল্লাদ বিশেষণ নেই তাদের কবি, লেখক, উকিল, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, আলেম,পুরোহিত, ঠিকাদার, হাসপাতাল-হোটেল ব্যবসায়ী পদবিতে অভিহত করা হয়

কেউ জনপ্রতিনিধি, কেউ নেতা, কেউ বক্তা, কেউ ধর্মীয় আলখেল্লা আবৃত জল্লাদ কোনো কোনো জল্লাদ ব্যবসায়ী পরিচয় ধারণ করে আছে এদের কেউ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রেতা, কেউ মাছ-সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, কেউ কাপড় বিক্রেতা, কেউ ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রেতা কেউ রিকশা-সিএনজিওয়ালা, কেউ বাস-ট্রাকের ড্রাইভার-কন্ট্রাক্টর, রেলের টিটি চারিদিকে শুধু জল্লাদ আর জল্লাদ

জল্লাদ শাহজালালের মনে মনে ভাবতে থাকে জেল থেকে বের হওয়ার জন্য জেলের ভিতর সে যে কাজগুলো করেছিল সেগুলো হয়ত আইনত বৈধ কিন্তু জেলের বাইরে বেঁচে থাকতে হলে তাকে যা করতে হবে সেগুলো আইনত অবৈধ নৈতিকভাবেও অশুদ্ধ তার সৎ পথে চলার প্রতি পদক্ষেপে বাধা আর বাধা এতো বাধা অতিক্রম করার শক্তি, বুদ্ধি বা কৌশল কোনোটাই তার জানা নেই শরীরী বয়সে বৃদ্ধ হলেও নতুন পৃথিবীতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেতো কোনো শিশু বা কিশোর  চাইতেও কম নয় শাহজালালের মনে হতে থাকে সমস্ত বাংলাদেশটাই জল্লাদে ভরা একটি অনিরাপদ স্থান জেলের ভিতরটাই যেন শুধু নিরাপদ কোনো জায়গা

ছোট শিশু যেমন মায়ের কোলে নিরাপত্তা খোঁজে, জল্লাদ শাহজালালও নিরাপত্তার খোঁজে আবারও জেলে ঢোকার উপায় খুঁজে থাকে......

 জল্লাদ

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

সকাল .০৬

১৮ জুন ২০২৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়া


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ