Ticker

6/recent/ticker-posts

তালপত্রের গুপ্তধন


বাড়ির পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ খুঁজতে গিয়ে স্টোর রুমে একটি মাঝারি সাইজের টিনের বাক্স সাদৃশ্য বস্তু খুঁজে পেলাম। আমাদের বাড়িটি বেশ পুরোনো। প্রায় শতবছর আগে আমার দাদার বাবা এই বাড়িটি বানিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নামি পাট ব্যবসায়ী। বেশ বড়ো বাড়ি। বাড়ির এক পাশের অনেকগুলো কামরা পাটের গুদাম হিসেবে ব্যবহার হতো। প্রায় সবগুলোই এখন পরিত্যক্ত। বাড়ির মূল অংশগুলো কয়েকবার সংস্কার করা করার ফলে এখনো আমরা ব্যবহার করে চলছি। দাদার আমলেই পাটের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঐ গুদাম কামরাগুলো আর কখনো ব্যবহার বা সংস্কার করা হয়নি। বন্ধ কামরাগুলোরই একটা ছিল সেই স্টোর রুম।

জায়গা জমি সংক্রান্ত একটি পুরোনো দলিল খুঁজতে গিয়ে এই টিনের বাক্সের দেখা পাই। কী আছে এটাতে! জানার প্রবল আগ্রহ নিয়ে সেটা খুলতে গিয়ে দেখলাম পুরোনো জং-ধরা একটি তালা লেগে আছে। চাবি পাবো কোথায় ! আলমারিতে; আশেপাশে হন্য হয়ে চাবি খুঁজতে লাগলাম। হতে পারে কোনো গুপ্তধন পেয়ে গেছি আমি। হতে পারে পেয়ে গেছি কোনো আশ্চর্য জিনিস। আগ্রহের আতিশয্যে ভুলেই গেলাম পুরোনো তালাইতো ভেঙে ফেললে দোষ কী! অবশেষে হাতুড়ি দিয়ে তালাটি ভাঙা হলো। বাক্সের ভিতর দেখে আমি আরও বিস্মিত হয়ে গেলাম। কালো কাপড়ে মোড়া কিছু একটা। খুললাম।

না কোনো গুপ্তধন খুঁজে পাইনি। তবে যা পেয়েছি তা মোটেও সামান্য কিছু নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ‘তালপত্র’। এই সেই তালপত্র, আগের দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখা হতো যে তালপত্রের গায়ে। এখানে সেরকম কিছুই এটা। কীভাবে আসলো এখানে তা বুজতে পারছিলাম। আমার দাদা ও তার বাবা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ছিলেন। এই তালপত্র তাদের লেখার কথা নয়। কোনো ব্যবসায়ী, লেখক, পথিক বা অন্য কেউ হয়ত এটা দাদা বা তার বাবার কাছে বিক্রি করেছিলেন অথবা জমা রেখেছিলেন। পরে আর ফেরত নেননি। দীর্ঘদিন অযত্ন অবহেলায় এখানেই রয়ে গেছে।

সাবধানে তালপত্রের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলাম। দুর্বোধ্য ভাষা! দেখতে অনেকটা বাংলা বর্ণমালা হলেও পড়তে বেশ দুরূহ। কী করা যায়, এসব নিয়ে ভাবছিলাম। বাক্সটি বন্ধ করে রেখে আমি আবার ভাবতে লাগলাম কী লেখা আছে তাতে। এগুলো দিয়ে আমি কি করবো। দিয়ে দিতে পারি কোনো জাদুঘরে। কিন্তু তার আগে এখানে কী লেখা আছে জানার আগ্রহ দমাতে পারছিলাম না মোটেও। হতে পারে কোনো অসাধ্য সাধন করার যাদুমন্ত্র। হতে পারে কোনো লুকিয়ে থাকা গুপ্তধনের রহস্যের সমাধান। হতে পারে কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের অমূল্য বাণী। হতে পারে কোনো কবির রচিত মহামূল্যবান সাহিত্যকর্ম। কোনো রাজা বাদশার অজানা ইতিহাস। হারিয়ে যাওয়া কোনো রাজকন্যার দুঃখের গল্পও হতে পারে।

ভাবতে ভাবতে দু-দিন চলে গেল। কোন কুল কিনারা পেলাম না। অবশেষে হঠাৎ মনে হল এটি সংস্কৃত, প্রাকৃত, অসমিয়া, অপভ্রংশ বা অন্য কোনো প্রাচীন ভাষা হতে পারে। যদি এগুলোর কোনটি হয় তাহলে কোনো গবেষক, ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক বা কলেজের বাংলা শিক্ষককে দেখালে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। মনে আবার সন্দেহ দেখা দিল, সত্যিই যদি কোনো গুপ্তধনের খোঁজ হয়ে থাকে তাহলে তিনি সেটা পড়ে আমাকে সত্য জানাবেন কি’না। এসব ভাবনা দুর্ভাবনার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজে যখন কিছু করতে পারবো না, সুতরাং কারো না কারো সহযোগিতাতো নিতেই হবে।

এক কলেজের বাংলা শিক্ষক আমার পরিচিত ছিলেন। ফোন নাম্বার বের করে তাকে কল দিলাম। সব খুলে বললাম। শুনে তিনিও খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। খুব মজাদার, বিস্ময়কর কিছু আবিষ্কারের সাক্ষী হতে পারবে জেনে তিনিও বিষয়টি নিয়ে খুব আগ্রহী হলেন। বললেন- ঐ তালপত্র দেখার জন্য পরদিন বিকেল বেলায় চলে আসবেন বাসায় । 

অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে পরদিন বিকেলে তিনি হাজির হলেন। সাথে আরেকজন ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন তিনি আমার পূর্বতন শিক্ষক। প্রাচীন বাংলা ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে। তাই তাকে নিয়ে এসেছি। বললাম- খুব ভালো করেছেন। ড্রয়িং রুমে তাদের বসতে দিয়ে গিন্নীকে বললাম চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে। আমি নিয়ে আসলাম সেই টিনের বাক্স।

বাক্স খুলেই তালপত্র হাতে নিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলেন তারা দু’জন। কিছুক্ষণ পর পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগলেন সব। আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলেন সেই ভদ্রলোক। অনেক কিছু পড়া যায় না। অস্পষ্ট তালপাতা উপরে কোনো অমুছনীয় কালি দিয়ে লেখা ছিল সে ভাষার বাক্যগুলো।

মোট বিশটি আলাদা আলাদা পাতায় ছয়টি করে বাক্য লেখা। সব পড়ে ভদ্রলোক জানালেন- ‘এগুলো আসলে উপদেশমূলক কিছু বাক্য। কোনো সাহিত্য না’কী ধর্মীয় বাণী তা বোঝা যাচ্ছে না। এটি অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য রতন হতে চলছে এবং আপনি সেই আবিষ্কারের অন্যতম একজন হতে যাচ্ছেন।’ বললেন তিনি। আপনি এটিকে বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর অথবা এই জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারেন গবেষণার পরেই এগুলো কবে, কার লেখা বা কী লিখেছে এই বিষয়গুলো জানতে পারবো বলে মত জানালেন। 

আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হলাম কী এটা। সেই সঙ্গে গুপ্তধন পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেও বঞ্চিত হলাম। তবে যা পেয়েছি তাও অসাধারণ কিছু একটা। ততক্ষণে চা-নাস্তা চলে এসেছিল। তাদের দুজনের হাতে চা এগিয়ে দিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম আপনিতো পড়েছেন। আমাকে দু-একটি বাক্যের অর্থ করে শোনান তো।

নিজের হাতের চা একটা চুমুক দিয়ে কাপটি নিচে রেখে তিনি একটি পাতা হাতে নিলেন এবং মন্ত্রের মতো সেটি ভাঙা-ভাঙা উচ্চারণে পড়ে নিলেন। তারপর যা তর্জমা করলেন তার অর্থ হলো....

“সবার কাছে ভালো থাকার মন্ত্র আমি জানি,
কিন্তু সেটা মানতে গেলে
নিজে আর ভালো থাকি না,
তাই সবার কাছে ভালো হতে চাই না।

কিছু মানুষ আমাকে মন্দ বলে জানুক না,
তাতে ক্ষতি কী ?


(সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘গুঞ্জন’ মা সংখ্যায় প্রকাশিত ছোটগল্প )
তালপত্রের গুপ্তধন
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২খ্রি. তিতাস পাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ