Ticker

6/recent/ticker-posts

বাঁচার জন্য আমার প্রথম লড়াই.....



১৯৮৫ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের ভিতরে-বাহিরে দৌড়াদৌড়ি করছেন একজন ব্যক্তি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অসুস্থ স্ত্রীর জন্য তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মহিলাটি গর্ভবতী, তার সঙ্গে আরো নানান জটিলতা যুক্ত হয়েছে। অবস্থা খুবই ভালা না। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ঐ ব্যক্তিকে বললেন- “রোগীর অবস্থা গুরুতর। দু’জনকে বাঁচানো সম্ভব না। হয়তো মাকে বাঁচাতে হবে, অথবা বাচ্চাকে। পেটের বাচ্চাকে বাঁচাতে গেলে হয়তো মাকে বাঁচাতে পারবেন না। আপনি কোনটা চান, ভেবে বলবেন।”

লোকটি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার আরো দুইটি সন্তান ছিল। দুই জনই ছেলে। সমাজের আট দশ জন মানুষের মত তারও একটি কন্যা সন্তানের বড়ো শখ ছিল। তখন আমাদের দেশে এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। তাই তিনি জানতেন না গর্ভের শিশু ছেলে না মেয়ে। জানতে পারলে হয়তো তার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল। কিন্তু যেহেতু জানেন না তাই ধরে নিলেন অনাগত সন্তান কন্যা হলেও হতে পারে। কাজেই অনেক ভেবেচিন্তে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি ডাক্তারকে অনুরোধ জানালেন- “ডাক্তার সাহেব আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন দুজনকে বাঁচানো যায় কী’না।” ডাক্তার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন- “দুই একদিন অপেক্ষা করে দেখতে পারি, এর মধ্যে যদি অবস্থা ভালোর দিকে যায় তাহলে দুইজন কে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। অবস্থার উন্নতি না হলে আপনাদের যেকোনো একজনকেই বেছে নিতে হবে। আপাতত চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু টাকা খরচ হবে।”

স্বল্প বেতনে চাকরি করা সেই ভদ্রলোক তার অফিস থেকে লোন নিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করালেন। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে আল্লাহর রহমতে তার স্ত্রী ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল দুটি প্রাণ। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় চলে আসলেন তারা। আরো একটু সুস্থ হয়ে অবশেষে তাদের গন্তব্য সুদূর সিরাজগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। অসুস্থ মহিলাটি চলে আসলেন তার বাবার বাড়ি সদর উপজেলার সোহাতায়। তারপর জুন মাসের প্রথম দিকে একটি সন্তানের জন্ম হল। পাড়া-প্রতিবেশী যখন উন্মুখ হয়ে আছে সদ্যোজাত সন্তানটি ছেলে না মেয়ে জানার জন্য, তখন দাই এসে খবর দিলেন এবারও পুত্র সন্তান জন্ম হয়েছে। মুহূর্তই সবার আনন্দে কিছুটা ভাঁটা পড়ে গেল। সকলের মুখ যখন গোমড়া শিশুটি তখন কেঁদে উঠলো তার অনাগত মৃত্যু প্রতিরোধ করে জন্ম নেয়ার আনন্দে। আত্মীয়-স্বজন, দূর সম্পর্কেও এক আত্মীয় ছেলেটির নাম রাখলেন তৎকালীন বাংলা ছায়াছবির একজন জনপ্রিয় নায়ক এর নামে। মায়ের পেটে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করেছে যে শিশু সে নায়ক না হয়ে যায় কোথায়।

৩৬ বছর পর ছেলেটি সেই ভয়ংকর দৃশ্যটির কথা চিন্তা করে এখনি শিউরে ওঠে। তার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। চোখ-কান গরম হয়ে আগুন ছুটতে থাকে। একটি নিষ্পাপ, নিরুপায় শিশু। তার সামনে অসুস্থ মা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাবা বিমর্ষ, চিন্তিত, দ্বিধান্বিত। তার সামনে সাদা পোশাক পড়া মৃত্যু দূত। হাতে ভয়ংকর কিছু অস্ত্র (ছুরি, ইনজেকশন) বড় বড় ডিগ্রি নেওয়া তার কাছে রয়েছে কাউকে মেরে ফেলার আইনত অধিকার। অথচ শিশুটির বাঁচার জন্য কিচ্ছু নেই। তার হাত, পা, চোখ, মুখ থাকলেও কোন কিছুতেই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ অস্তিত্ব থেকেও তার তখন কোনো অস্তিত্ব নেই। শিশুটির মন-মগজে তখন কী চলছিলো ভেবে ভেবে অন্তহীন হয়ে যায়। কী শক্তির বলে, কোন ক্ষমতার বলে, কার দোয়ায় সেদিন বেঁচে গিয়েছিল সেই অনাহত মৃত্যুর হাত থেকে। সম্ভবত একেই বলে “রাখে আল্লাহ মারে কে” ? 

আজ, এতো বছর পর সেই শিশুটি এখনো খুঁজে বেড়ায় সেই ডাক্তারকে। জন্মের আগেই তার মৃত্যু লিখে দেওয়া সেই ডাক্তারকে বলতে চায়- সেই ছেলেটি এখনো বেঁচে আছে। শহর জুড়ে তার নামডাক, তাকে নিয়ে শত আলোচনা-সমালোচনা। জন্মের আগে থেকেই বাঁচার জন্য যে লড়াই সে শুরু করেছিল, এখনো তার সে লড়াই চলছে।

(আমার জন্মের আগেই আমার মৃত্যুর পরওয়ানা লেখা সেই ডাক্তারকে আমি এখনো খুঁজে বেড়াই)

বাঁচার জন্য আমার প্রথম লড়াই.....
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ।
২৪ নভেম্বর ২০২১খ্রি.
লোকনাথ দিঘিরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ