Ticker

6/recent/ticker-posts

রহিজ উদ্দিনের দিনকাল

ছোটগল্প......                     

রহিজ উদ্দিনের দিনকাল

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ



রিকশায় উঠেই চালকের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো ইমতিয়াজ রাজু। অনার্স পড়ুয়া ইমতিয়াজ লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করে। জেলা শহরের একটি স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করে সে। সম্প্রতি যোগ দিয়েছে ঢাকার একটি নতুন পত্রিকায়। তার সাংবাদিক মন আর অনুসন্ধানী দৃষ্টি এখানে সেখানে নানান ঘটনা আর গল্প খুঁজে বেড়ায়। তাই রিকশায় উঠেই চালকের সঙ্গে কথাবলা তার নিয়মিত অভ্যাস। আহামরি কোনো গল্প নয়, এই নাম কী, বাড়ি কোথায়, পরিবারে আর কে কে আছে, ছেলেমেয়ে লেখাপড়া কী’না এইসব। এসব আলাপের মাঝেই কখনো সখনো তাদের সুখ-দুঃখের অনেক গল্প জানা হয়ে যায় তার।

রিকশা চালকদের সঙ্গে সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ খারাপ ব্যবহার করে থাকে। ডাক দেয়ার সময় তুই-তাহার ব্যবহার করে। চলতে চলতে কথা বলে রাগী স্বরে। আস্তে চালা, জোরে চালা। ভালো কথাও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। নামার পরেও ভাড়া নিয়ে করে ক্যাচাল। ন্যায্য ভাড়া দিতে চায় না অনেকেই। দু-একজন যারা একটু ভালো ব্যবহার করে বা খোশগল্প করে তাদের কথা নিতান্তই এড়িয়ে যায় না এই চালকরা। 

আজ কুমাড়শীল মোড়ে এই রিকশা খালি দেখতে পেয়ে তাকে ডাকলো ইমতিয়াজ। রিকশাওয়ালা বলল- ওঠেন ভাই। ইমতিয়াজ বলল- ভাড়া কত দিতে হবে বলেন। রিকশাওয়ালা বলে- আপনি যা দিবেন তাই খুশি। ইমতিয়াজ রিকশা উঠতে উঠতে বলে- আমি যদি আপনার চাহিদা মত ভাড়া না দিই, তাহলেও কি আপনি খুশি হবেন। রিকশাওয়ালা বলে- আপনে আমারে ঠকাইবেন না মিয়া ভাই। ইমতিয়াজ অবাক হয়ে বলে- আপনি কি আমাকে আগে থেকেই চেনেন। রিকশাওয়ালা বলে- নাম চিনি না। তয় আমরা মানুষ দেখলেই বুজতে পারি, কে ভালো, আর কে খারাপ। এবার হাসতে হাসতে ইমতিয়াজ বলে- কীভাবে আপনার তা বুজতে পারেন, আমাকে শেখাবেন। রিকশাওয়ালা বলে- ভাই আপনি আমাকে সুন্দর কইরা ডাক দিয়া বলছেন ‘এই রিকশাওয়ালা ভাই পৈরতলা যাইবেন।” হগলে এমনে ডাক দেই না ভাই। তুই-তোয়াক্করি করে। এই খালি যাবি, এই রিকশা দাঁড়া, এমন কইরা ডাক দেয়। হেরার ডাক শুনলেই মেজাজ খারাপ হইয়া যায়। খালি পেটের কথা চিন্তা কইরা সহ্য করি। কিন্তু আপনে আমারে ‘আপনি’ কইরা ডাক দিছেন। আপনার ডাক আমার ভালো লাগছে। তাই বুজছি আপনি ভালো মানুষ। ইমতিয়াজ বলে- ও আচ্ছা। তারপর রিকশাওয়ালাকে তার স্বভাবসুলভ নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকে ইমতিয়াজ। আর ইমতিয়াজের সব উত্তর দিচ্ছিলেন সেই রিকশাচালক। ব্যাটারি চালিত রিকশাটি এগিয়ে চলছে জেল রোডের মোড় ঘুরে হালদাপাড়ার রাস্তা ধরে। 

কথায় কথায় সে জানায় অন্য আরো অনেক রিকশাচালকের মতোই সেও ময়মনসিংহ জেলার কোন গ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এসেছে। তার নাম রহিজ উদ্দিন। বছর দুয়েক আগেও নিজ এলাকায় ছোটখাটো একটি মুদির দোকানের ব্যবসা ছিল তার। ভালোই চলছিল তার ছোট্ট দোকান। সংসারও ছিল ছোট, স্বল্প আয়ে দিন কেটে যেত বেশ। তারপর দেশে আসলো করোনা মহামারী। লকডাউনের ফাঁদে পরে সবার ব্যবসার মতো তার ব্যবসাও উঠল লসের খাতায়। এক দেড় বছর কোনরকম ব্যবসাটাকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। করোনার পর কিছুটা সফলও হয়েছিল।

এক নাগারে কথাগুলো বলছিল রহিজ। হালদারপাড়া এসে জুবলি রোডের মোড় ঘুড়ে একটু জিড়িয়ে নিয়ে আবার বলল- বুজছেন ভাই, গরিব মানুষ যেই দিক যায় হেই দিকই বলে হুকনা হয়। বলেই তার পরের কাহিনিগুলো বলতে শুরু করল সে। করোনার মাইরটা খালি সামাল দিয়া উঠছিলাম, তারপর আবার শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। যুদ্ধের লাইগা বলে দেশের সব জিনিসপত্রের দাম বাইড়া গেছে। বুজলেন ভাই কোন খানে কোন রাশিয়া আর ইউক্রেন যুদ্ধ করতাছে। হের লাইগা আমরার দেশের জিনিসপত্রর দাম বাড়লো। আমরা মুর্খ-সুরুক্ষ মানুষ, অতো কিছু বুজি না। তয় এর মধ্যে আমরার দেশের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীগোর একটা চালাকি আছে হেইডা ঠিকই বুজি। সব হইতাছে সিন্ডিকেটের খেলা, গরিব মারার ফন্দি। 

ব্যাটারি চালিত হলেও ধীরে গতিতে রিকশা চালাতে চালাতে রহিজ বলতে থাকে- জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সাথে সাথে তার দোকানের বাকী কাস্টমারের সংখ্যাও বেড়ে গেল। আর সেই বাকীগুলি উদ্ধার করতে পারছিল না সে। এভাবে বাকী জমতে জমতে একসময় তার ব্যবসাটি লসে পরিণত হলো। ধার দেনা করেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারলো না। তারপর তাদের সুখের সংসারে নেমে আসলো অভাব-অনটন আর অশান্তি। বাধ্য হয়ে রিকশা চালাতে হলো তার। নিজের এলাকায় চালাতে লজ্জা হয়। সব পরিচিত মানুষ। এজন্যই এই শহরে আসা।

ইমতিয়াজ রহিজ উদ্দিনের জীবনের করুণ কাহিনী জেনে খুব দুঃখ প্রকাশ করলো। মধ্যপাড়া মেল ঘরের মোড়ে জ্যামে আটকা পড়লো তাদের রিকশা। তবে রহিজের মুখ চলতেই থাকল। এবার কথায় কথায় ইমতিয়াজ আরও জানতে চাইলো ‘রিকশা চালিয়ে তার এখন দৈনিক কত টাকা আয় হয়। এই দিয়ে তার সংসার চলে কী’না।

রহিজ উদ্দিন উত্তর দেয় ‘আল্লার সব দিন তো সমান যায় না বাইসাব। মাইঝে মাইঝে বালা ইনকাম অয়। আবার মাইঝে মাইঝে খুব খারাপ যায়। ভাড়া রিকশা চালাই। প্রত্যেকদিন মালিকরে দেওন লাগে ৩০০ টেহা। আর ১০০ ট্যাহা দিই গ্যারেজ ভাড়া, ২০০ টাকা জমাই কিস্তি আর বাসা ভাড়া দেওনের লাইগা। বাহি ট্যাহা দিয়া কোনরকমে বৌ-পোলা-মাইয়া লইয়া দিন কাটাই।



জ্যাম কাটিয়ে রিকশা তখন ছুটতে শুরু করেছে। তাদের এসব কথাবার্তার মধ্যেই পৈরতলা খানাকাশরীফ এর কাছে পৌঁছে যায় ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের বাসার কাছে রিকশাটি থামিয়ে চালকের আসন থেকে নামে রহিজ। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল “স্যার জিনিসপত্রের দাম তো ম্যালা। তয় সংসার চালাইতে আমাগো তেমন সমস্যা হয় না। আল্লার রহমতে আমরার খুব বেশি খাওন-পিন্দন লাগে না। তাই কম ট্যাহা দিয়াই দিন পার অইয়া যায়। তয় অসুক-বিসুখ অইলে সমস্যাটা বাইড়া যায়।”

এরমধ্যে কথায় কথায় তার ভাড়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ কথাটি বলেই রিকশায় ঘুরিয়ে উঠে দ্রুত প্যাডেল চালায় রহিজ। চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায়। রাস্তা ঘুরতেই কাঠ বাগানের আড়ালে দৃষ্টির আড়াল হয় তার রিকশাও। তার এই কথার ফাঁকে ইমতিয়াজ খেয়াল করলো রিকশাচালকের চোখের কোনায় বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। সম্ভবত চোখের পানি আড়াল করতেই সে তাড়াতাড়ি চলে গেল।

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে- রহিজ উদ্দিন জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক যোদ্ধা। তার সোনালি অতীত তাকে স্মৃতিকাতর করে। আবার একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় সে তার কষ্টের দিন হাসিমুখে বরণ করে নেয়। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে সাথে বাজার ব্যবস্থার অসামঞ্জস্যতা। এর সঙ্গে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তার মতো আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন দরিদ্র মানুষেরা তাদের নীরব কান্না এভাবেই লুকিয়ে রাখে। রিকশার উপরে সিটে বসে কোনো কোনো ইমতিয়াজরা হয়তো সেটা দেখেন। বেশির ভাগ মানুষরাই তা দেখতে পায় না।






মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

কবি, লেখক ও সংগঠক

মোবাইল:  ০১৭১৭-০৯৫৭৫১

ইমেইল:  mishrabon@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ