Ticker

6/recent/ticker-posts

রোজার বাজার



অফিসের ফাইল উল্টাতে উল্টাতে আলতাফ আহমেদ তার সহকর্মী শরিফ উদ্দিনকে বললেন- বুঝলেন শরিফ ভাই, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেম নাই, তাদের ইমান আমলও ভালো না।

শরিফ উদ্দিন একটু নড়েচড়ে বসলেন, মজার কিছু শুনবেন ভেবে হাতের কাজ রেখে তাকালেন আলতাফ আহমেদের দিকে। বললেন - কেন, কি হয়েছে ভাই , কে আবার কি করল ?

আলতাফ: আরে ভাই শোনেন না, রোজার কয়েকদিন আগে গিয়েছি বাজারে, রোজার বাজার করব বলে। জিনিসপত্রের এত দাম, যেইটা ধরি সেইটাই যেন আগুন।

শরিফ: এ আর নতুন কি ভাই ! প্রতিবছরইতো রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।

আলতাফ: তা ঠিক, তবে এই বছর মনে হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। আমার স্পষ্ট মনে আছে, গত বছর রোজার বাজার করলাম, পনেরো হাজার টাকা লেগেছে। এই বছর এটা আটাশ হাজার লাগলো। এত টাকা দিয়ে বাজার করলে কি হয় বলেন ?

শরিফ: পুরো মাসের বাজার একসাথে করে ফেলেছেন নাকি। আমি অবশ্য এক মাসের বাজার একসাথে করি না। পনেরো দিনের বাজার করি। বোঝেনতো আমি একা মানুষ। এতগুলো বাজার বয়ে আনা বিরাট সমস্যা।

আলতাফ: আমি ভাই রোজার বাজার একসাথেই করি। রোজা-রমজান মাস। সেহরি ইফতারে একটু ভালো মন্দ না খেলে এবাদতে মন বসে না। তাছাড়া রোজা রেখে বাজারে যাওয়া ভালো লাগে না। তাই রোজার আগেই সব বাজার একসাথেই করে ফেলি।

শরিফ: তা ভাই ঠিকই বলেছেন, রোজার মাসে বাজার করা ভালো লাগে না। আগে করে ফেললেই ভালো।
আলতাফ: যে কথা বলছিলাম ভাই, রোজা-রমজান মাস। কোথায় ব্যবসায়ীরা একটু দাম কম রাখবে, তা না করে কয়েকগুণ বেশি রাখে। আর ভেজালের কথা না হয় না-ই বললাম। 

শরিফ: ঠিক বলেছেন ভাই, ফেসবুকে দেখলাম রোজা উপলক্ষে আরব দেশগুলোতে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়। এবার নাকি ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও রোজা উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম কমেছে। আর আমাদের দেশে রোজা আসার আগে থেকেই সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। আমাদের ব্যবসায়ীরা আর ভালো হলো না।

আলতাফ: সেই জন্যই তো বললাম, একেকজনের দেশপ্রেম নাই, ইমান আমল ঠিক নাই। টুপি পাঞ্জাবি পড়ে ব্যবসা করে। আবার জিনিসপত্র কম দামে বিক্রি করে না। এই লাভ কি আর হালাল হবে বলেন ?

শরিফ: শুনলাম ভোক্তা অধিকার আর প্রশাসনের লোকজন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। প্রশাসনের লোকজন যেদিকে যায়, সেই দিকে একটু দাম কমে। তারা ফিরে আসলে আবার আগের দামে বিক্রি করে। এসব অভিযানে বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না।

আলতাফ: ঠিকই বলেছেন, দেশের সাধারণ মানুষ কীভাবে যে বাঁচবে বুঝি না। চাকরি করেওতো আমরা ঠিকমতো সংসার চালাতে পারি না। বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসা আরো কত কি। দিন দিন পরিস্থিতি শুধু খারাপ দিকে যাচ্ছে।

তাদের এসব কথাবার্তা শুনছিলেন সহকর্মী রায়হানুল ইসলাম। শরীফ সাহেব এবার রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন। কি ব্যাপার রায়হান সাহেব, কিছু বলছেন না যে। রোজার বাজার করেছেন নাকি ?

রায়হান সাহেব এই অফিসে নতুন এসেছে। এখনো এক বছর হয়নি। এর মধ্যে অফিসের অনেকেই তাকে কিছুটা এড়িয়ে চলেন। একজন সৎ, কর্মনিষ্ঠ কর্মচারী হিসেবে আর যেমন সুনাম আছে, তেমনি ঠোঁটকাটা হিসেবে তার দুর্নামও আছে। হঠাৎ করে যে কাউকে কটুকথা বলতে তার একটুও বাঁধে না। শরীফ সাহেবের কথার প্রতিউত্তরে রায়হান সাহেব বললেন-

রায়হান: আর বাজার করতে পারলাম কোথায়। আমিতো ভাই প্রতি শুক্রবারে অথবা শনিবারে বাজার করি। এবার রোজার আগের শনিবারে বাজারে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। বাজারে মানুষ আর মানুষ । কিন্তু বাজারেতো তেমন কোনো জিনিসপত্র নেই, প্রায় খালি।

আলতাফ সাহেব এবং শরিফ সাহেব অনেকটা উৎসুক হয়ে বললেন- কি, কি বললেন, বাজারে মালামাল নাই ! কি হয়েছে সব জিনিসপত্র ?

রায়হান: ওই যে রোজার আগে, সবাই রোজার বাজার করার জন্য বাজারে গিয়েছে। অনেকে এক মাসের, কেউ বিশ দিনের, কেউ পনেরো দিনের বাজার একসাথে করে নিয়ে এসেছে। এখন বাজারে মালামাল কম পড়ে গেছে। যে কয়েকটি দোকানে আছে, সেখানে আবার জিনিসপত্রের দাম চার/পাঁচ গুণ বেশি। 

আলতাফ : তাই নাকি ? আমরা যখন বাজারে গেলাম তখনতো দেখলাম বাজারে কত জিনিসপত্র। এখন কি সব শেষ হয়ে গেছে। এত খাবার কারা খায় ?

শরিফ: আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। জিনিসপত্রের এত দাম, তারপরেও সব মালামাল শেষ। এত দাম দিয়ে মালামাল কেনে কে ?

রায়হান: আপনাদের মত আমিও অবাক হয়ে ছিলাম। কয়েকজন দোকানদারকে বললাম- ভাই এত মালামাল কেনে কে, কাদের এত টাকা পয়সা। দোকানদার উত্তরে আমাকে কি বলল জানেন ?

আলতাফ ও শরিফ: কি বলল ?

রায়হান: দোকানদার বলল- প্রচুর লোকজন এখন বিদেশ গিয়ে মেলা ধনী। তাছাড়া দেশে কি আর অবৈধ ইনকামকারী, ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাব আছে ? সবার হাতে অনেক টাকা পয়সা। তাদের জন্য একমাস না ছয় মাসের বাজার একসাথে করলেও কোনো সমস্যা নেই। 

অফিসের পিয়ন রুবেল তাদের এসব কথা শুনছিলো। এবার সে বলে উঠলো- 

রুবেল : স্যার ছোডো মুহে একটা কতা কই, হেরার ট্যাহার সমস্যা নাই, কিন্তু আমরারতো ম্যালা সমস্যা। হেরা বেবাগ মালামাল আগে কিন্না রাহে দেইহাইতো বাজারে মালে টান পড়ে। দোকানদার দাম বেশি রাহে। এমুন কইরা চললে আমরার মতো গরীব বাঁচবে ক্যামনে ?

রুবেল ও রায়হান সাহেবের কথা শুনে শরিফ সাহেব ও আলতাব সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তারা অযথা এই ফাইল ঐ ফাইল টানাটানি করতে লাগলো।


ছোটগল্প: রোজার বাজার
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
১৩ মার্চ ২৪
টেংকেরপাড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ