Ticker

6/recent/ticker-posts

আলোর কথা, ভালোর কথা

“ইসাবেলার রোগটা খুব জটিল। শুধু উন্মাদ বললে ওর রোগ সম্পর্কে কিছুই বলা হবে না। রোগটার একটা নাম আছে ‘সিজোফ্রেনিয়া’। প্রচলিত ভাষায় বলা হয় ‘বিভাজিত ব্যক্তিত্ববোধ’। এ রোগের লক্ষণ হল রোগী মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে নিজের পরিচয় ভুলে যায়, নিজেকে অন্য মানুষ হিসেবে কল্পনা করে। শুধু নিজে নয়, চেনা মানুষদেরও পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্য মানুষ হিসেবে কল্পনা করে। তাদের ওপর আরোপ করে কল্পিত ব্যক্তিত্ব। এভাবে আলাদা একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিজের চারপাশে।সে জগতে নিজেকে এবং অন্যদেরকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করায়।

জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমাক রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা ব্ল্যাক অবিলিক্স’ বইয়ে গল্পের নায়ক লাডইউগ বডমার তার খণ্ডকালীন চাকরি সুবাদে জানা পাগলাগারদে থাকা একজন রোগী সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেন।

সম্প্রতি আমাদের দেশে দুইটি মেয়ে নিজের কথা ও কাজের জন্য ভাইরাল হয়ে এখন স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইউটিউবারদের মুখোমুখি। দুজনের বয়সের বিস্তর ফারাক। বয়সের পার্থক্যের মতো এই দুজনের চিন্তারও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। একজন বয়সে ছোট হয়েও সমাজে আলোর বার্তা ছড়াচ্ছে। অন্যজন বয়সে বড় হলেও ছড়াচ্ছেন অন্ধকারের বার্তা। একজন স্বভাবসুলভ সরলতা ও লাজুকতায় নিজের দিকে ছুটে আসা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কি দিচ্ছে না। অন্যজন প্রশ্নের উত্তর দিতে চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছেন, ভুল উত্তর দিচ্ছেন, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন।

বস্তিতে থাকা ছোট্ট সেই মেয়ের ঘর আগুনে পুড়ে গেলেও সে তখন হাসছিলো, একজন সাংবাদিক তাকে এ হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায়- ‘হাসমু না! আমার মা বাঁইচা আছে এইটাই বেশি। সবকিছু পুড়ে গেলেও আমার মা তো আছে। মানুষ থাকলে তো কামাই করা যাইব, মানুষ না থাকলে কী হইব।’

৮/৯ বছরে এই ছোট্ট মেয়ের বিপদের মধ্যেও মাতৃভক্তির এই উদাহরণ দেখে দেশবাসী আনন্দিত, অনুপ্রাণিত হয়েছে। দেশে যেখানে মাঝে মাঝে বৃদ্ধ, অসহায় বাবা-মার উপর সন্তানদের নির্যাতন, রাস্তাঘাট, জঙ্গলে ফেলে দেওয়া অথবা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার ঘটনাগুলো ভাইরাল হয়, ঠিক সে সময় ছোট এই মেয়ের মায়ের প্রতি ভালোবাসা আমাদের অন্ধ সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মা কি জিনিস, মার কত মূল্য ।

প্রায় একই সময় ২৫-৩০ বয়সী আরেকজন মেয়ে ও বাংলাদেশে ভাইরাল হলো। যে কয়েক মাস আগেও ঢাকা মেডিকেলে ভুয়া ডাক্তার হিসেবে ধরা পড়ে কিছুদিন জেলে ছিল। জেল থেকে বের হয়ে সম্প্রতি সে একটি টিভি চ্যানেলে নিজেকে আসল ডাক্তার দাবি করছে। কিন্তু উপস্থাপকের অনেক প্রশ্নের সে উত্তর দেয়নি, অনেক প্রশ্নের উল্টাপাল্টা উত্তর দিয়েছে। যে প্রশ্নগুলো মেডিকেল সাইন্সতো বটেই একেবারেই সাধারণ ও সচেতন মানুষরাও মাত্রই জানে।

ভিডিওটি দেশব্যাপী ভাইরাল হলে দেশের সবাই যখন বুঝতে পেরেছে মেয়েটি আসলেই একটি ভুয়া ডাক্তার ।এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন নানা উপহাস, ট্রল করা হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেও মেয়েটি তার নিজের ডাক্তার হওয়ার দাবির পক্ষে অটল। এই দাবির পক্ষে সে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিজের বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রতিবারই বিভিন্ন প্রশ্নের ভুলভাল উত্তর দিয়ে নিজেকে ভুয়া প্রমাণ করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও তার আত্মবিশ্বাস এবং বলার ধরন দেখে আমার ১৩/১৪ বছর আগে পড়া ব্ল্যাক অবিলিক্স-এর ইসাবেলার কথা মনে পড়ে গেল।

ব্ল্যাক অবিলিক্স উপন্যাসে সেই পাগলা গারদে আরেকটি পাগল লোক ছিল। তার ধারণা তার মাথা কাচ দিয়ে তৈরি। সাবধানে নাড়াচাড়া না করলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাই সে যেখানে দাঁড়ায় সেখানেই চুপচাপ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ বাগানে থাকে ততক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। একদম নড়াচড়া করে না। মাথার খুব মূল্য দেয় সে, চায় না তার মাথা ভেঙ্গে যাক।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের বিভিন্ন গণমাধ্যম, ফেসবুক, এবং ইউটিউব চ্যানেলে এরকম কিছু পাগল আছে যাদের মাথাও কাচ দিয়ে দিয়ে বানানো। তাদের মাথায় কোনো মগজ নেই। হাতুরী দিয়ে তাদের মাথা ভেঙে ফেলি। মগজ থাকলে এই পাগলা মুনিয়া রোজার একটি ভিডিওতে যখন স্পষ্ট হল মেয়েটি প্রকৃত ডাক্তার নয়, সে প্রতারণা আশ্রয় নিয়েছে অথবা সে মানসিকভাবে পাগল তখন বারবার তার কাছেই কেন সবার যেতে হবে।

এই দেশে এসব ছাড়াও আর কত সমস্যা আছে তা আমাদের সবারই জানা। কত হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তার সাধারণ রোগীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ঔষধ কেনার টাকা নাই কত মানুষের কাছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে কত মানুষ। আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে আছে কম মানুষ। কত মানুষের ঘরে প্রয়োজনীয় আসবার পত্র নাই। কত মানুষের ঘরে খাবার নাই। কত মানুষ ঋণের চাপে পড়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কত বাবা-মা তাদের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া খরচ যোগাযোগ করতে পারছে না। কোনো সরকারি অফিসে অনিয়মের বেড়াজালে পৃষ্ঠ হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সাধারণ কর্মচারী। কোথায় রাস্তা নেই, কোথায় হাসপাতাল নেই, চিকিৎসক নেই, কোথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই।

এসব হাজারো সমস্যা যে দেশে, সেই দেশের গণমাধ্যম কর্মীরা, অনলাইন চ্যানেল আর ইউটিউবাররা এমন সব বিষয় নিয়ে মাতামাতি করে তখন তাদেরকেও আমার মগজহীন মানুষ বলে মনে হয়। পরিমনি, শাকিব, বুবলি, অপু, হিরো আলম, মোস্তাক-তিশা, সাবরিনা বা মুনিয়া রোজা আমাদের জাতীয় সমস্যা নয়। এরা আমাদের হিরোও নয়। এরা, এদের কাজ সমাজে অন্ধকারের বার্তা দেয়। তাদের নিয়ে আমরা যত কম চর্চা করব ততই ভালো নয় কি ? জান্নাতের মত ছোট মেয়েরাই আমাদের  আসল হিরো। তাদের যত প্রচার করব- ততই লাভ।

পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই- আমাদের পৃথিবীতে, আমাদের সমাজে আলো এবং আঁধার পাশাপাশি বাস করে। আসুন আমরা আলোর চাষ করি, আলোর উৎপাদন করি, আমরা আলোর কথা, ভালোর কথা ছড়িয়ে দেই। যে কালো, যে অন্ধকার, যে অন্ধকারে বাস করে, সে অন্ধকারেই থাকুক- তাদের নিয়ে আমাদের চর্চা না করলেই হলো।

আলোর কথা, ভালোর কথা

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

২৯ মার্চ ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ